তারেক মাসুদ: চলচ্চিত্রের ফেরিওয়ালা

638

লিখেছেন  রুবাইয়াৎ আহমেদ

২০১১’র ১৩ আগস্ট, মর্মান্তিক সড়ক দূর্ঘটনায় তারেক মাসুদ নিহত হওয়ার তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় লেখা…

কস্মাৎ এক বেদনা ঘনিয়ে এসেছে আমাদের আকাশে। তার জন্য পূর্বপ্রস্তুতি ছিল না কোনো, তা থাকবার কথাও নয়। তবু পার্থিব বাস্তবতা এই, আমাদের শিল্পভূগোল থেকে চলচ্চিত্র নির্মাতা তারেক মাসুদকে ছিন্ন করে নিয়ে গেছে কাল। যে যাত্রায় তাঁর অন্তর্ধান, সেই একই পথ পাড়ি দিয়েছেন বিশিষ্ট সাংবাদিক ও চিত্রগ্রাহক মিশুক মুনীর। তাদের সঙ্গী হয়েছেন আরো তিনজন।

যে যায়, তার সর্বস্বটুকুই তো খোয়ায়। প্রতিটি প্রয়াণের সাথেই আকাশ ভারি হয় দীর্ঘশ্বাসে, পৃথিবীর জল খানিকটা বেড়েও তো যায় অগণিত মানুষের ক্রন্দনে! তাঁদের সবার অকাল প্রস্থান চিরকালীন এক শোকচিহ্ন হয়ে থাকবে আমাদের মনে, যারা জীবিত এখনো।

 ২. 
চলচ্চিত্রের প্রতি একজন অনুরক্ত হিসেবে তারেক মাসুদের কাজের সাথে পরিচিত হওয়ার সুযোগ ঘটে আমার। প্রায় কৈশোরউত্তীর্ণকালে তাঁর মুক্তির গান চলচ্চিত্রটির মধ্য দিয়ে পরিচয়ের সূত্রপাত। আজ অবধি রানওয়েতে এসে সেটি স্থিত হয়েছে। কিন্তু কাগজের ফুল নিয়ে ওড়ার সুযোগটুকু আর পাওয়া গেল না। ১৩ আগস্ট তিনি পাড়ি জমালেন চিরঘুমের দেশে, কালো পিচঢালা নির্দয় পথে ঘাতক যান তাকে বিচ্ছিন্ন করে নিলো। তারেক মাসুদের মাটির ময়নাটি আশ্রয় নিলো মাটির ঘরে।

ভীষণ বড় ওই মানুষটির সাথে কয়েকবার টেলিফোন আলাপ ছাড়া সরাসরি যোগাযোগ হয়নি কখনো। নেত্রকোণা সাহিত্য সমাজ প্রতি বছর বসন্তকালীন সাহিত্য উৎসবের আয়োজন করে। ওই উৎসবের এক আসরে তিনি উদ্বোধক হতে সম্মত হয়েছিলেন। সংগঠনের পক্ষ থেকে তাঁর সাথে যোগাযোগের ভার পড়ে আমার ওপর। আর এ কারণেই ওই প্রাণবন্ত মানুষটির সাথে আলাপের অর্থাৎ সংযোগের সূচ্যগ্র অভিজ্ঞতাটুকু আমার সঞ্চয়ে রয়ে গেছে। আকস্মিক ব্যস্ততার কারণে শেষ পর্যন্ত তিনি আমাদের আয়োজনে সশরীরে অংশ নিতে পারেননি। কিন্তু তারপরও তিনি ছিলেন আমাদের সমগ্র আয়োজনের শুভার্থী হয়েই। বিনয়ী ওই মানুষটি কতভাবে, কত সংকোচে যে তাঁর ওই অপারগতা প্রকাশ করেছেন! অঙ্গীকার করেছিলেন, কোনো একদিন যাবেন নিশ্চয় আমাদের নেত্রকোণায়। তিনি রেখেছেন তাঁর দেয়া কথা, আজ ঠিকই তো তিনি নেত্রের কোণে জল হয়ে ঠাঁই করে নিয়েছেন!

তবু সরাসরি সংযোগের বাতাবরণ ভেদ করে তাঁর সাথে ভিন্ন যোগাযোগ ছিল। বাংলার মাঠে ময়দানে চলচ্চিত্রের ফেরি করে বেড়িয়েছেন তিনি। আর এইভাবে সৃষ্টির মধ্য দিয়ে আমার মতো অগণিত মানুষের সাথেই তিনি যুক্ত থেকেছেন। সেই সম্বন্ধ তো শিল্পের, স্বার্থরহিত যথাযোগ্য সম্বন্ধ।

মাটির ময়না । রোকন-আনুর মতো, তারেক মাসুদেরও শৈশব কেটেছে মাদ্রাসাতে...
মাটির ময়না রোকন-আনুর মতো, তারেক মাসুদেরও শৈশব কেটেছে মাদ্রাসাতে…

 ৩. 
১৯৫৬ সালে ফরিদপুর জেলার ভাংগা উপজেলার নূরপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন তারেক মাসুদ। সংস্কৃতিমনা এবং উদারধর্মীয় আবহে ঘেরা পরিবারেই তারেকের জন্ম। কিন্তু বেড়ে ওঠার কালে তারেকের তৎসময়ের গ্রাজুয়েট পিতা আকস্মিকভাবে ধর্মপন্থার দিকে ঝুঁকে পড়েন। এতে করে তারেক ও তার মায়ের ওপর নেমে আসে নানা ধরনের ধর্মীয় বিধিনিষেধ। বাড়িতে পর্দাপ্রথার প্রচলনসহ তারেকের বাবার ইচ্ছে জাগে ছেলেকে ধর্মশিক্ষায় শিক্ষিত করে তুলবেন। এ কারণেই তারেককে ভর্তি করে দিলেন মাদ্রাসায়। এ ভূখণ্ডের বিভিন্ন মাদ্রাসায় তারেকের পাঠগ্রহণ চলতে থাকে। কিন্তু তারেকের বাবার পাকিস্তানদর্শনে চিড় ধরায় বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ। তিনি উপলব্ধি করেন, ধর্মীয় ভ্রাতৃত্বের চেয়ে একই সাংস্কৃতিক ও জাতি সত্তায় বিকশিত মানুষের নৈকট্যই প্রকৃত সত্য। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর নারকীয় হত্যাযজ্ঞ আর নির্যাতনের পরও মুক্তিকামী মানুষ তার লড়াই থেকে পিছু হটেনি। ফলে যে বিরুদ্ধস্রোতে তারেককে একসময় ভাসিয়ে দিয়েছিলেন তাঁর পিতা, সে অবস্থান থেকে সরে আসেন তিনি। বুঝতে পারেন, মানুষকে তার নিজপ্রকৃতির বাইরে ঠেলে দিলে তা ভালো কিছু বয়ে আনে না। পাকিস্তানিরা যেমন পারেনি এদেশের মানুষের আকাঙ্ক্ষার বিরুদ্ধে চাপিয়ে দিতে তাদের সংস্কৃতি ও অর্থনৈতিক আগ্রাসন। এ কারণে মুক্তিযুদ্ধের পর ১৯৭৩ সালে পিতার উদ্যোগেই তারেক ম্যাট্রিক পরীক্ষা দিয়ে উত্তীর্ণ হন। এরপর তারেক ঢাকার আদমজী ক্যান্টনমেন্ট কলেজ থেকে পাশ করার পর তারেক ভর্তি হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগে।

মূলত কলেজে পড়াকালীন সময় থেকেই তারেক যাতায়াত শুরু করেন ঢাকার সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে। তখন থেকেই বাংলাদেশ ফিল্ম সোসাইটিতে তারেকের নিয়মিত আনাগোনা। কিছুদিনের মধ্যেই তিনি হয়ে ওঠেন চলচ্চিত্র সংসদ আন্দোলনের একজন সক্রিয় কর্মী। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির পর তারেক চলচ্চিত্র সম্পর্কে আরো পঠন-পাঠনের মধ্যদিয়ে নিতে থাকেন প্রস্তুতি। তার সেই প্রস্তুতির প্রথম নিদর্শন আদম সুরত। ১৯৮২ সালে বিখ্যাত শিল্পী এস এম সুলতানের জীবন ও কর্মের ওপর ভিত্তি করে তিনি নির্মাণ করেন এই চলচ্চিত্রটি। আদম সুরত নির্মাণকালেই এবং একে কেন্দ্র করেই তারেকের পরিচয় ঘটে যুক্তরাষ্ট্রের তরুণী ক্যাথরিন শেপিয়ারের সাথে। তাদের এই পরিচয় কালে মোড় নেয় দাম্পত্যজীবনে। ক্যাথরিন নিজেও একজন চলচ্চিত্র নির্মাতা। তারেক আমৃত্যু ক্যাথরিনের সাহচর্যেই ছিলেন। আদম সুরত-এ ক্যামেরা চালিয়েছেন মিশুক মুনীর। যে যৌথশিল্প তারেক ও মিশুক এক সঙ্গে শুরু করেছিলেন, আর এক যৌথশিল্প নির্মাণের খোঁজ করতে গিয়ে দু’জনেই একসাথে পাড়ি জমালেন চিরকালের অদেখা জগতে

 ৪. 
তারেক মাসুদের আত্মজৈবনিক আখ্যানের শিল্পরূপ মাটির ময়না। আমাদের জাতীয় জীবনের একটি গুরুত্বপূর্ণ সন্ধিক্ষণের চিত্ররূপ এই চলচ্চিত্রটি। সীমার মধ্য দিয়ে অসীমের ব্যাপ্তির মতোই বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের আগের কয়েক বছরকে তিনি সেলুলয়েড ভার্সনে তুলে ধরেন। কতিপয় চরিত্রের দোলাচলে আর নির্বাচিত দৃশ্যবিন্যাসে বিশাল এই জনপদের ঐতিহ্য, ধর্ম, পারিবারিক ব্যবস্থা, প্রকৃতি, রাজনীতি আর ভৌগলিক চারিত্র্য যেন বা উঠে আসে কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই। কিন্তু সেই উঠে আসার মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয় তারেকের গন্তব্য, তিনি দর্শকের ভেতরে নানা ভাবনার, নানা জিজ্ঞাসারও জন্ম দিয়েছেন। এতে করে পরিণত মানুষ নিজেই সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রাজ্ঞতা অর্জন করে ফেলে যেন বা। চলচ্চিত্রটি অনেকগুলো প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে, সেই প্রশ্নগুলোর মধ্যে ইতি-নেতির দ্বদ্বও রয়েছে। কিন্তু কোনো উত্তর নেই। প্রকৃতঅর্থে নির্মাতা তারেক কোনো উত্তর দিতে চান নি। কেননা, তাঁর উপস্থাপনা কৌশলের ভেতরেই রয়েছে উত্তরের খোঁজ। শিল্পে এই গুপ্ত কিংবা খানিক আভাস অথবা রহস্যময়তাই জিয়নকাঠি। নয়তো সব দৈনন্দিন। আমরা লক্ষ করি, ১৯৭৪ সালে চলচ্চিত্র আন্দোলনের সাথে যুক্ত তারেক দীর্ঘ ২৮ বছর পর ২০০২ সালে মুক্তি দেন তাঁর প্রথম কাহিনীচিত্র মাটির ময়না। একটি যথাযোগ্য শিল্প সৃষ্টিতে ব্যক্তির এই ধৈর্য্য ও প্রতীক্ষা সত্যিই বিরল। তারেক মাসুদ এখানেও ব্যতিক্রমী শিল্পসাধক। এতদীর্ঘ সময় ধরে প্রস্তুতি আর অপেক্ষার নির্মোহ দৃষ্টান্ত স্থাপন করে, তিনি আমাদের অভিজ্ঞতায় দ্বিতীয়রহিত হয়ে রইলেন।

মাটির ময়না । রোকনদের পরিবারের মতোই, শৈশবে তারেক মাসুদের পরিবারে নেমে আসে পিতার তরফ থেকে নানা ধরনের ধর্মীয় বিধিনিষেধ
মাটির ময়না । রোকনদের পরিবারের মতোই, শৈশবে তারেক মাসুদের পরিবারে নেমে আসে পিতার তরফ থেকে নানা ধরনের ধর্মীয় বিধিনিষেধ

 ৫. 
একটি মাদ্রাসার ছাত্র-শিক্ষকদের প্রাত্যহিক কর্মকৃত্য দিয়ে মাটির ময়না চলচ্চিত্রটির যাত্রারম্ভ। শীতের কোনো এক ভোরে শিক্ষার্থীদের ওজু ও শিক্ষাগ্রহণের মধ্য দিয়ে ক্রমশ অতীতচারী কৌশলে এগিয়ে যায় এর কাহিনী পরম্পরা। এই মাদ্রাসার শিক্ষার্থী আনু নামের এক কিশোরকে কেন্দ্র করে এর ধারাবাহিকতা রক্ষিত হয়। আমরা দেখতে পাই, একই সকালে মাদ্রাসায় পাঠগ্রহণরত আনু আর তারই পরিবারের খানিক বৃত্তান্ত। আনুর মা আয়েশার পিঠা তৈরির দৃশ্য আমাদের এই ভূগোলের শীতকালীন বিশেষ খাদ্যাভ্যাসের ঐতিহ্যটি উঠে আসে। গ্রামীণ এক সম্পন্ন পরিবারে বেড়ে উঠলেও ধর্মীয় কুহকবিভ্রমগ্রস্ত আনুর পিতা কাজী মাজহারুল ইসলাম তাকে মাদ্রাসায় পাঠিয়ে দেয়।

আনুর বোন আসমা কিছুদিন ধরে জ্বরে ভুগছে। আনুর বাবা হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসক কাজী সাহেব নিজেই চিকিৎসা করছেন। মেয়ের জ্বর না কমার অভিযোগ শুনে কাজী সাহেব এর জন্য আসমার বাইরে ঘোরাঘুরিকেই দায়ী করেন। মেয়েকে নিয়ে কথোপকথনের এক পর্যায়ে আয়েশা ঘরের আধো অন্ধকার তাড়াতে জানালা খুলে দেয়। বাইরে বিপুলা সবুজ প্রকৃতি। প্রাণের স্ফূরণ ও বিকাশ যে প্রকৃতিতে তারই এক আহবান যেন বা এই ক্ষুদ্র অথচ তাৎপর্যময় দৃশ্য। মেয়ে আসমার সঙ্গীহীনতা ও ছেলে আনুকে মাদ্রাসায় পাঠিয়ে দিয়ে তাকে নিঃসঙ্গ করে দেওয়ার অনুযোগ করে আয়েশা ঘর থেকে বেরিয়ে যাওয়ার পর মুহূর্তে বাইরে থেকে সেই জানালার ওপর একটি ক্লোজশট স্থির হয়ে থাকে। ঘরের ভেতরে থাকা কাজী সাহেব উঠে এসে আস্তে করে জানালার সামনে দাঁড়ান। ক্যামেরা খানিক টিলড-আপ হয়ে স্থির। কারাগারের মতো রডের বিন্যাসে নির্মিত ওই জানালায় বহুদিন ধরে চর্চিত সংস্কারের মতো মাকড়শার জাল ঝুলে আছে। জানালাটি বন্ধ করে দিয়ে কাজী সাহেব ধর্মান্ধতার গহবরেই যেন বা নিজেকে লুপ্ত করেন। কাজী চরিত্রটি আপাত নিরীহ এই দৃশ্যের অবতারণায় এক লহমায় সমগ্রসহ অঙ্কিত হয়ে যায়। পরক্ষণেই মাদ্রাসার নিরেট দেয়ালের দৃশ্য এসে ঠেকে আনকাট ট্রলি ঠেলে আনুর চুল কর্তনের মুহূর্তে। কিন্তু ধর্মীয় এই শিক্ষায়তনের কঠোরতা কঠিন দেয়ালগাত্র দর্শনে দর্শকের ভেতর প্রবিষ্ট হয়। আনুর চুলে কাচি চালাতে চালাতে ক্ষৌরকার দান করেন ধর্মীয় ও শ্রেণীগত বিভাজনের পাঠ।

মাদ্রাসার এই নিস্তরঙ্গ জীবনে আনুর একমাত্র বন্ধু হয়ে ওঠে রোকন নামের অপর এক কিশোর। এই গণ্ডীবদ্ধতা রোকনকে ক্রমে অসুস্থ করে তোলে। শেষ পর্যন্ত অপ্রকৃতিস্থ হয়ে গেলে তাকে বন্দি করা হয় মাদ্রাসার মালখানায়।

নরসুন্দর-এর শুটিংয়ে; তারেক মাসুদ ও মিশুক মুনীর । যে যৌথশিল্প তারেক ও মিশুক এক সঙ্গে শুরু করেছিলেন, আর এক যৌথশিল্প নির্মাণের খোঁজ করতে গিয়ে দু’জনেই একসাথে পাড়ি জমালেন চিরকালের অদেখা জগতে...
নরসুন্দর-এর শুটিংয়ে; তারেক মাসুদ ও মিশুক মুনীরযে যৌথশিল্প তারেক ও মিশুক এক সঙ্গে শুরু করেছিলেন, আর এক যৌথশিল্প নির্মাণের খোঁজ করতে গিয়ে দু’জনেই একসাথে পাড়ি জমালেন চিরকালের অদেখা জগতে…

আনুকে মাদ্রাসায় পাঠানোর কার্যকারণ উদঘাটিত হয় খানিক পরে। আমরা দেখতে পাই, কাজীর ছোটভাই মিলনের সাথে বাংলার ঐতিহ্যবাহী নৌকাবাইচ দেখে ফেরার পর এই নির্দোষ বিনোদনটিকে ‘হিন্দুয়ানী’ আখ্যা দিয়ে আনুকে ‘রক্ষার’ নামে মাদ্রাসায় ভর্তি করে দেন কাজী সাহেব। মিলন প্রগতিশীল রাজনীতির সাথে জড়িত।

উদ্ভট ভৌগলিক বিভাজনের মধ্য দিয়ে পাকিস্তান নামক রাষ্ট্রযন্ত্রটির উদ্ভব। এই অংশ পূর্ব পাকিস্তান আর হাজার মাইল ব্যবধানে পশ্চিম পাকিস্তান। এই দুয়ে মিলে ‘পাকিস্তান’। অখণ্ড ভারত হিন্দু ও মুসলিম এই দুই ‘জাতি’তে বিভক্ত হয়ে তিনখণ্ডে দুটি রাষ্ট্রে ভাগ হয়ে যায়। কিন্তু পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকেরা এই অঞ্চলকে দেশ হিসেবে নয়, নিজেদের উপনিবেশ হিসেবেই গ্রহণ করে। ফলে সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক, ধর্মী ও রাজনৈতিক প্রভৃতি সব ক্ষেত্রেই এ অঞ্চলের অধিবাসীদের সাথে বৈষম্যমূলক আচরণ জারি রাখে। রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলাকে প্রতিষ্ঠার যে আন্দোলন তা ক্রমশ এই অঞ্চলের মানুষের মধ্যে সূচনা ঘটায় সামগ্রিক মুক্তি আন্দোলনের। এ ভূখণ্ডের মানুষ ধীরে ধীরে অগ্রসর হয় ভাষা ও ঐতিহ্যভিত্তিক ধর্মনিরপেক্ষ স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার দিকে। কিন্তু তারমধ্যেও কতিপয় ধর্মান্ধ লিপ্ত হয় ইসলামি রাষ্ট্র হিসেবে পাকিস্তানকে বহাল রাখার চেষ্টায়।

কাজীকে আমরা দেখতে পাই সেই পাকিস্তানপন্থীদের সারিতে। পাকিস্তানিদের প্রতি তার বিশ্বাস এতোটাই গভীরে প্রোথিত যে, অন্তিম দৃশ্যে দেখা যায়, হানাদার বাহিনীর হামলায় ভস্মীভূত ঘরের ভেতরে ধর্মগ্রন্থের পুড়ে যাওয়া খণ্ডিত পৃষ্ঠা হাতে দাঁড়িয়ে থেকেও তাদের প্রতি অবিশ্বাস আনতে পারে না সে। তাকে খানিক বিস্মিত দেখায় শুধু। এ সময়েও যখন পাকিপ্রেমীদের চাক্ষুস করি, তখন আমাদের চোখে ভেসে ওঠে তারেকের সৃষ্ট কাজীর অবয়ব। সেই দৃশ্যে আমরা দেখতে পাই, আয়েশা ছেলেসন্তান আনুকে নিয়ে পালাতে থাকে বেঁচে থাকার তাগিদে, নতুন জীবনের সন্ধানে। এখানেই চলচ্চিত্রটির আপাত-সমাপ্তি ঘটে। আপাত এইঅর্থে যে, আমাদের ভেতরে তখন নতুন মুক্তির গান শুরু হয়। এ ভূখণ্ডের মানুষের মুক্তিযুদ্ধের অকৃত্রিম দৃশ্যগুলো তারেকের মুক্তির গানে তাল ঠুকেছে। যেন বা মায়ের সাথে বেরিয়ে পড়া আনুই এককালে মাদ্রাসা পড়ুয়া তারেক মাসুদ।

মুক্তির গান তবে কি মাটির ময়নার সিক্যুয়াল! ঠিক নিশ্চিত নই। কিন্তু ঐতিহ্যনিষ্ঠ তারেকের সাংস্কৃতিক আন্দোলনমুখীনতা সেদিকেই তো আলো ফেলে, যুদ্ধের বিভীষিকাময়কালে সীমান্ত ঘুরে ঘুরে সুরেসঙ্গীতে মুক্তিকামী মানুষের মনে উদ্দীপনা যোগানো দলের অভিযান, সে তো তারেকেরও গন্তব্য।

আন্তর্জাতিকভাবে বহুলপ্রশংসিত মাটির ময়না বিশ্ব চলচ্চিত্রের অন্যতম সম্মানজনক আসর বলে পরিচিত কান চলচ্চিত্র উৎসবে আন্তর্জাতিক ক্রিটিক অ্যাওয়ার্ড অর্জন করে। বাংলাদেশের কোনো চলচ্চিত্র ও নির্মাতার জন্যে এ এক বিশাল প্রাপ্তি।

স্মৃতি-ভাস্কর্যে আলো জ্বালছেন ক্যাথরিন মাসুদ
স্মৃতি-ভাস্কর্যে আলো জ্বালছেন ক্যাথরিন মাসুদ

 ৬. 
২২ আগস্ট ২০১১, সন্ধ্যায় শাহবাগের শওকত ওসমান মিলনায়তনে দেখা হলো তারেকের পরিচালিত সর্বশেষ পূর্ণাঙ্গ কাহিনীচিত্র রানওয়ে। তারেক ও মিশুকসহ ওই সড়ক দুর্ঘটনায় প্রয়াতদের স্মরণে আয়োজিত আনুষ্ঠানিকতা ছিল সেটি। বিমান উড্ডয়ন আর অবতরণস্থলের সাথে আমাদের সমকালীন জীবনের একটি ভয়ঙ্কর সমস্যার যোগসূত্র স্থাপনে যে প্রতীকময়তার আভাস তিনি দিয়েছেন, তা তাঁর অসামান্য শিল্পরূচি শুধু নয়, জীবনকে দেখা-বোঝার ক্ষেত্রেও স্বতন্ত্র পারঙ্গমতার ইঙ্গিতবাহী। আমরা দেখতে পাই, এদেশীয় অসৎ রাজনৈতিক নেতৃত্ব, ধর্মীয় কুহক এবং স্বার্থপরতার চিত্র। সেই সাথে শ্রমজীবী মানুষের লড়াই, বিদেশফেরত সর্বস্বান্ত মানুষের হাহাকার আর বিত্তবৈভবে বসবাসকারী ধনিক-লুটেরা শ্রেণীর আধিপত্য। তাতে আন্তর্জাতিক পরিপ্রেক্ষিতও গুপ্ত থাকেনি। অথচ এই বিরুদ্ধকালেও পরিবারের স্নেহশীল বন্ধন এখনো অটুট। শেষদৃশ্যে তাই দেখতে পাই, জঙ্গিবাদের অন্ধকার গহবর ছেড়ে স্বাভাবিক পারিবারিক জীবনে ফিরে আসা ছেলেকে আলোকময় দুগ্ধে স্নাত করছে তার মা। যেন বা সন্তানকে পরিশুদ্ধ করে জীবনের প্রতি আহবানের এক অনুপম চিত্র এটি। ঋণদাতার চায়ের জন্য দুধের হাড়ি শূন্য থাকলেও সন্তানের জন্য তা চিরকালই অনিঃশেষ। যে রানওয়ে দিয়ে বিমানের উড্ডয়ন, সেই একই পথ ধরে নেমে আসে আকাশযান। মানুষের জীবনেও সেই একই পথ, ওই পথ দিয়ে যেতে পারো অন্ধকার জীবনে কিংবা উঠে যেতে পারো সাফল্যের চূড়ায়, আবার ফিরেও আসতে পারো আলোকময়তায় অথবা নামতে পারো গভীর খাদে। কে কোনটা নেবে– সে বিচারের ভার ব্যক্তির।

রানওয়ে দেখা শেষে গভীরবেদনাবোধ নিয়ে বেরিয়ে আসি হল ছেড়ে। আমার হাতে তখন কালো আর লালে ছাপা একটি ভাঁজপত্র। তাতে লেখা–
          বন্ধু, আমরা তোমাদের কবর দিইনি,
          আমরা তোমাদের রোপণ করেছি
          ছাপান্ন হাজার বর্গমাইলে…

কারো সাথে আত্মার নৈকট্য অনুভবই আত্মীয় করে তোলে। রক্তসম্পর্করহিত এই অকালপ্রয়াত মানুষটির সাথে রুচি বিশ্বাসে অন্তরঙ্গতা অনুভব করেছে অগণিত মানুষ। তিনি হয়ে উঠেছিলেন প্রিয় থেকে প্রিয়তর। তাঁর এই আকস্মিক অনাকাঙ্ক্ষিত অন্তর্ধানে সর্বব্যাপ্ত শোক তাই সহজাত। কর্ম, ঐতিহ্যনিষ্ঠা, দক্ষতা ইত্যকার অসামান্য গুণে অনন্য এক শিল্পীতে পরিণত হয়েছিলেন তারেক। আমাদের সৎপ্রবৃত্তিজাত দৃশ্যমাধ্যম তাঁকে পাশ কাটিয়ে সম্মুখপানে ধাবিত হবে না কোনোদিন। জানি, জীবন একদিন ফুরাবে, তার তরী ভেসে হারাবে অনন্তের স্রোতে। তবু সময় পুরোবার আগে যেজন রাখে মাথা প্রাজ্ঞ মৃত্যুর কোলে, তার তরে জাগে শোক। যেজন চুকিয়ে দেয় জীবনের পাঠ, সেজন নির্ভার। আর আমরা এখনো নিঃশ্বাস নিচ্ছি যারা, ক্রমশ পুড়ে যেতে থাকি নীলাভ্র দহনে। তাতে নোনা জলের শুশ্রূষা নাই, কেবল ভেতরে চেপে বসে বেদনার হিমালয়।

তারেক মাসুদ নামে আমাদের হৃদয়ে চিরকালীন আসন পাতা হলো।

Print Friendly, PDF & Email
কবি, গবেষক, নাট্যকার, সাংবাদিক, সিনে-সমালোচক। জন্ম : নেত্রকোণা, বাংলাদেশ। পিএইচডির থিসিস : বাংলাদেশের চলচ্চিত্রে নারী-- শিল্প ও সমাজবাস্তবতার প্রেক্ষাপট [২০০০ সাল পর্যন্ত]। ফিল্মবুক : তারেক মাসুদ

8 মন্তব্যগুলো

  1. […] তারেক মাসুদ নামটি খুব নৈর্বক্তিকভাবে উচ্চারণ করা আমার জন্যে সহজ কাজ নয়। আমি তার ছাত্র, অনুসারী, সহযোগী বা উত্তরসূরী হলেও অন্য অনেকের মতোই আমিও তাকে তারেক ভাই বলে ডাকতাম। কিন্তু এই ভাই ডাকার অভ্যস্থতা দীর্ঘদিনের অভ্যাসে এত গভীরে প্রোথিত যে আনুষ্ঠানিক কারণেও শুধু নামটি উচ্চারণে আমার অস্বস্তি হয়। পুরো আলোচনায় আমি হয়তো তারেক ভাই বলেই তাকে উদ্ধৃত করব। […]

  2. […] এদিকে, সময়টা সত্তরের দশকের শেষভাগ হয়তো। লেখক আহমদ ছফার অনুবীক্ষণে ধরা পড়েছেন শিল্পী এসএম সুলতান। নড়াইল অঞ্চলের লাল মিয়া। কৃষিজীবী জীবনের বাংলাদেশই যার ক্যানভাসের মৌল উপাদান। ঔপনিবেশিক কারণেই এদেশের চিত্রকলায় চর্চিত পশ্চিমা রীতির একাডেমির বাইরে তার ওয়াশ, রেখা, আলো-ছায়া-দিন-রাত। ছফা, সুলতানের কাজের ওপরে একটি অনবদ্য অার্টিকেল লিখলেন। নগর জীবনের বাইরের শিল্পী সুলতান হিডেন থেকে একেবারে নাগরিক শিল্পীদের আলোচনায়, পাদপ্রদীপে চলে এলেন, নিশ্চয়ই তাঁর নিজের সৃজনী শক্তির বলেই। কিন্তু সুলতানকে ঢাকার নাগরিক জীবনে উন্মোচনে ধাত্রী হয়ে উঠেছিলেন লেখক-চিন্তক আহমদ ছফা। আবার ছফার টোলের যারা ছাত্র, তাদেরই একজন তরুণ চলচ্চিত্র করিয়ে তারেক মাসুদ। […]

Leave a Reply to ডিজিটাল সিনেমার পথচলা : প্রেক্ষাপট বাংলাদেশ/ শৈবাল সারোয়ার | ফিল্মফ্রি

Please enter your comment!
Please enter your name here