একজন মুহম্মদ খসরু

2153
বায়োস্কোপ, চলচ্চিত্র প্রভৃতি
শাহাদুজ্জামান
প্রকাশক বাঙলায়ন; ঢাকা । প্রথম প্রকাশ ফেব্রুয়ারি ২০০৯ । পৃষ্ঠা সংখ্যা ১৭৬ । দাম ২৫০ টাকা

লিখেছেন । শাহাদুজ্জামান


 

রুশ লেখকরা যেমন গোগলের ওভারকোট থেকে বেরিয়েছে, তেমনি আমরা সব বেরিয়েছি খসরু ভাইয়ের পকেট থেকে– বলছিলেন বিকল্প ধারার এক তরুণ চলচ্চিত্রকার। বাংলাদেশে যে তরুণ, তরুণী শিল্পান্মেষার কৌতুহলে চলচ্চিত্র চর্চা করেছেন, চলচ্চিত্র সংসদ আন্দোলনের সঙ্গে জড়িত হয়েছেন, চলচ্চিত্রের নান্দনিকতা নিয়ে লেখালেখি করেছেন, যিনি মনে মনে শিল্পসম্মত একটি চলচ্চিত্র নির্মাণের স্বপ্ন দেখেছেন, তাদের মধ্যে এমন কাউকে খুঁজে পাওয়া দুষ্কর হবে, যিনি প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে মুহম্মদ খসরুর সঙ্গে পরিচিত নন।

সেই ষাট দশকের গোড়ায় এ অঞ্চলে প্রথম চলচ্চিত্র সংসদ প্রতিষ্ঠা করে আধুনিক এই শিল্পমাধ্যমটিকে সিরিয়াস একটি চর্চার বিষয়ে পরিণত করেছিলেন মুহম্মদ খসরু। বাংলাদেশের চলচ্চিত্র আন্দোলনের পথিকৃত তিনি। পঞ্চাশ দশকে সত্যজিৎ রায় এবং চিদানন্দ দাশগুপ্তের গড়া কলকাতা ফিল্ম সোসাইটির অনুপ্রেরণায় মুহম্মদ খসরু, ওয়াহিদুল হক প্রমুখরা মিলে ঢাকায় গড়ে তোলেন ফিল্ম সোসাইটি। ওয়াহিদুল হক পরবর্তীতে গানে মনোনিবেশ করলে খসরুই হন এই আন্দোলনের কাণ্ডারী।

মুহম্মদ খসরু । নিজ উদ্যোগে তৈরি করেছেন চলচ্চিত্র সাহিত্যের বিশাল লাইব্রেরি
মুহম্মদ খসরু । নিজ উদ্যোগে তৈরি করেছেন চলচ্চিত্র সাহিত্যের বিশাল লাইব্রেরি

আশির দশকের গোড়াতে বন্ধুর সঙ্গে আলাপ করছিলাম, কি দারুণ হতো যদি বইয়ের মতো দোকানে গিয়ে সত্যজিৎ রায় কিংবা ডি সিকার ফিল্মগুলো কেনা যেত। বছরখানেকের মধ্যেই সত্য হলো সে কল্পনা বিলাস। ধানমণ্ডি সাত মসজিদ রোডের প্রথম ভিডিও দোকানটিতে যাবার সেই বিস্ময় মনে আছে এখনও। সে বিস্ময়কে ফিকে করে দ্রুত চলে এলো সিডি, ভিসিডি। যে কোনো বইয়ের চেয়েও সস্তা দরে এখন মিলে যায় বিশ্বখ্যাত সব ধ্রুপদী চলচ্চিত্র।

কিন্তু মুহম্মদ খসরুরা যখন আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্রের ব্যাপারে আগ্রহী হয়েছেন, তখন একটি বিদেশি ছবি যোগাড় করা ছিল দুরূহ ব্যাপার। বই কিংবা রেকর্ডের সুবাদে আন্তর্জাতিক সাহিত্য আর সঙ্গীতের সঙ্গে এ দেশের মানুষের পরিচয় ঘটলেও আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র ছিল একটি কুয়াশাচ্ছন্ন অঞ্চল। আর বিদেশি ছবি বলতে তখন কিছু ভারতীয় এবং হলিউডের ছবির সঙ্গেই পরিচয় ছিল সাধারণ দর্শকের। খসরু এবং তার সঙ্গীরা তখন নানা দূতাবাসের সহযোগিতায় আফ্রিকা, ল্যাটিন আমেরিকা, ইওরোপের অচেনা সব চলচ্চিত্রের প্রদর্শনী করে আগ্রহী দর্শকের জন্য খুলে দিয়েছিলেন চলচ্চিত্রের নতুন দিগন্ত। বিভিন্ন দেশ থেকে চলচ্চিত্র বিশেষজ্ঞদের এনে আয়োজন করেছেন সেমিনার, ওয়ার্কশপ। চলচ্চিত্রের নান্দনিক, রাজনৈতিক, কারিগরি মাত্রা নিয়ে প্রকাশ করেছেন চলচ্চিত্রপত্র, ধ্রুপদীর মতো মননধর্মী পত্রিকার। বাংলাদেশের প্রথম ফিল্ম আর্কাইভ প্রতিষ্ঠারও অন্যতম উদ্যোক্তা তিনি। নিজ উদ্যোগে তৈরি করেছেন চলচ্চিত্র সাহিত্যের বিশাল লাইব্রেরি। প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে এ দেশের বহু মেধাবী তরুণকে মুহম্মদ খসরু টেনে এনেছেন চলচ্চিত্র মাধ্যমটিতে, যাদের অনেকেই এখন জাতীয়, আন্তর্জাতিক পর্যায়ের চলচ্চিত্রব্যক্তিত্ব। বলা যায়, এ দেশে মননধর্মী, শিল্পগুণসম্মত চলচ্চিত্রের দর্শক এবং নির্মাতা তৈরির নেপথ্য কারিগর মুহম্মদ খসরু।

মুহম্মদ খসরু । প্রশ্রয় দেননি চলচ্চিত্রকে ঘিরে কোনো রকম স্থূলতা, কৃত্রিমতা, বালখিল্যতাকে
মুহম্মদ খসরু । প্রশ্রয় দেননি চলচ্চিত্রকে ঘিরে কোনো রকম স্থূলতা, কৃত্রিমতা, বালখিল্যতাকে

মুহম্মদ খসরুকে যারা ব্যক্তিগতভাবে চেনেন, তারা জানেন যে, মানুষ হিসেবে তিনি ক্ষেপাটে, রাগী, মুখে তার অবিরাম খিস্তি। তার সব রাগ, ক্ষোভ ঐ চলচ্চিত্রকে ঘিরেই। আশির দশকের মাঝামাঝি ঘনিষ্ঠতা হয়েছে তার সঙ্গে। দেখেছি, কেমন ঘোরগ্রস্তের মতো তরুণদের তাড়িয়ে বেড়াচ্ছেন চলচ্চিত্রের পথে। এ ব্যাপারে তিনি আপসহীন। চলচ্চিত্র বা চলচ্চিত্র সংসদ নিয়ে কোনো বাণিজ্যিক, রাজনৈতিক ফায়দা লুটবার প্রবণতা দেখলে তিনি সে তরুণের ব্যাপারে হয়েছেন নির্মম, চলচ্চিত্রের অপরিণত কোনো কাজ করে যে তরুণ আত্মতৃপ্তিতে ভুগছে, তার তৃপ্তির বেলুনটিকে ফুটো করে দিয়েছেন তীব্র খিস্তিতে, প্রশ্রয় দেননি চলচ্চিত্রকে ঘিরে কোনো রকম স্থূলতা, কৃত্রিমতা, বালখিল্যতাকে। যেন তিনি স্বেচ্ছায় তুলে নিয়েছেন সুস্থ চলচ্চিত্রের ট্রাফিকম্যানের ভূমিকা। কোনো প্রাপ্তিযোগের আশায় তা করেননি। সেই সময় একবার চলচ্চিত্র সংসদ আন্দোলনে তার ভূমিকা প্রসঙ্গে একটি লেখা লিখেছিলাম। ছাপাবার আগে জানিয়েছিলাম তাকে। ক্ষেপে গিয়েছিলেন প্রচণ্ড– ‘তোমারে কে কইছে আমারে নিয়া লেখতে?’ চুপসে গিয়েছিলাম।

তার দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গে হয়তো মতান্তর রয়েছে অনেকের, কারও তোয়াক্কা করে কথা বলেন না বলে হয়েছেন অনেকের বিরাগভাজন। তাই চলচ্চিত্রকে ভালোবেসে যেমন মিত্র, তেমনি তৈরি করেছেন শত্রুও। তবু হ্যামিলনের বাঁশিওয়ালার মতো বাজিয়ে গেছেন চলচ্চিত্রের বাঁশি। খসরু নিজে একটি চলচ্চিত্র নির্মাণের স্বপ্নও দেখেছেন দীর্ঘদিন। হাসান আজিজুল হকের নামহীন গোত্রহীন বইটি অবলম্বনে একটি চিত্রনাট্য তৈরি করে সঙ্গে বয়ে বেড়াচ্ছেন তিনি। কোনো প্রযোজক পাননি। রাষ্ট্রীয় অনুদানের জন্য জমাও দিয়েছেন বার দুয়েক, অনুদান মেলেনি। ফিল্ম আর্কাইভ প্রতিষ্ঠিত হবার পর এর কিউরেটর হিসেবে প্রস্তাব করা হয়েছিল তার নাম, কিন্তু তা বাতিল হয়েছে তার শিক্ষাগত যোগ্যতার প্রশ্ন তুলে। কবি নজরুল সুস্থ থাকলে সম্ভবত তিনিও বাংলা একাডেমির কোনো পদ পেতেন না ঐ শিক্ষাগত যোগ্যতার প্রশ্নে। ঘোলা রাজনীতির ডামাডোলের মধ্যে কিছু মানুষ জীবনপাত করেছেন তারুণ্যের মুখ শুভ আর কল্যাণের দিকে ফিরিয়ে রাখতে। আমরা সংস্কৃতির সেইসব সেনাপতিদের উপেক্ষা করেছি

ধ্রুপদী । চলচ্চিত্রের নান্দনিক, রাজনৈতিক, কারিগরি মাত্রা নিয়ে পত্রিকাটি প্রকাশ করেছেন মুহম্মদ খসরু
ধ্রুপদী । চলচ্চিত্রের নান্দনিক, রাজনৈতিক, কারিগরি মাত্রা নিয়ে পত্রিকাটি প্রকাশ করেছেন মুহম্মদ খসরু

মুহম্মদ খসরুকে এখন কদাচিৎ দেখা যায় আজিজ মার্কেটের করিডোরে। ন্যূজ হয়ে ঘুরে ঘুরে বই দেখছেন। আমার সাথেও শেষ দেখা বেশ অনেকদিন, ঐ বইয়ের দোকানেই। তার কথার বিষয় একটিই– চলচ্চিত্র। বললেন, ‘রোজা লুক্সেমবার্গের উপরে যে ফিল্মটা হইছে, দেখছো নাকি? দেইখা নিও।’ এই মানুষ বেঁচে আছেন সংসার করবার জন্য নয়, সম্পদ অর্জনের জন্য নয়, খ্যাতি কুড়াবার জন্য নয়, শুধুমাত্র একটি শিল্পমাধ্যমকে ভালোবাসবার এবং সে ভালোবাসা অন্যের মধ্যে বিলিয়ে দেবার জন্য। চারপাশে এ ধরনের মানুষ দুর্লভ হয়ে উঠছে ক্রমশ।


লেখকের অনুমতিক্রমে রিপ্রিন্ট করা হলো । মূল বইয়ে লেখার শিরোনাম, ‘চলচ্চিত্রের ট্রাফিকম্যান’ থাকলেও, লেখকের ইচ্ছেতে শিরোনামের বদল ঘটানো হলো… —ফিল্মফ্রি
Print Friendly, PDF & Email
কথাসাহিত্যিক; গবেষক । সিনে-গ্রন্থ : চ্যাপলিন, আজো চমৎকার; চলচ্চিত্র, বায়োস্কোপ প্রভৃতি । উপন্যাস : ক্রাচের কর্নেল; ঃতে দুঃখ । গল্পগ্রন্থ : কয়েকটি বিহবল গল্প; পশ্চিমের মেঘে সোনার সিংহ; শাহাদুজ্জামানের গল্প; অগল্প । ভ্রমণ : আমস্টার্ডাম ডায়েরী এবং অন্যান্য । গবেষণা গ্রন্থ : একটি হাসপাতাল, একজন নৃবিজ্ঞানী, কয়েকটি ভাঙ্গা হাড় । সম্পাদিত গ্রন্থ : দেখা না দেখার চোখ; আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের ডায়েরি । অনুবাদ গ্রন্থ : ভাবনা ভাষান্তর

6 মন্তব্যগুলো

  1. অসাধারন একটা লেখা, একজন অসাধারন মানুষকে নিয়ে।

  2. খুব দরকারি একটা লিখা। অনেক ধন্যবাদ। আমাদের দেশের অধিকাংশ লোকই ডিগ্রী ব্যপারটা নিয়ে পড়ে আছেন। কিছু শিখছেন বা জানছেন কিনা সেটা ব্যপারনা ডিগ্রীটাই আসল। তাইতো ডিগ্রী সর্বস্ব লোকে ভরা।
    ধ্রুপদী এবং চলচ্চিত্রকথা এর সব সংকলন কি বই আকারে একসাথে পাওয়া যায় ? পড়তে চাই।

  3. Hello , this is Tahmina daughter of Mahmudul Haque. I really liked your article about my favourite Khasru chacha. Thank you so much for the article about this important man . He used to love my dad n mom and me n my brother like his own family . I have lost him ever since I came to Canada . I would really appreciate if u kindly arrange me his phone number plz! Thanks

Leave a Reply to আসিফামি সৈকত

Please enter your comment!
Please enter your name here