আকিরা কুরোসাওয়া : সিনেমার স্বতন্ত্র সামুরাই

1429
  • মূল : ড্যান হার্পার । অনুবাদ : রুদ্র আরিফ

আকিরা কুরোসাওয়া
জন্ম : ২৩ মার্চ ১৯১০; ওমোরি, টোকিও, জাপান
মৃত্যু : ৬ সেপ্টেম্বর ১৯৯৮; সেতাগায়া, টোকিও, জাপান

কিছু সমাজকে ফিল্মের মাধ্যমে ঠাহর করা যায়; যেমন– জাপান। জাপানি ফিল্মমেকাররা অন্তত সে দেশের লেখকদের মতো বিদেশে বিশদভাবে পরিচিত। নোবেলজয়ী জাপানি সাহিত্যিক জুনিচিরো তানিজাকি, ইয়সুনারি কাবাবাতা ও কিনাবুরো ওয়ে যেমনি বিদেশে তাদের লেখা নিয়ে সমাদৃত হয়েছেন, ইয়াসুজিরো ওজু, নাগিসা ওসিমা আর তাকেসি কিতানোও তেমনি জাপানের অবয়ব, এর ল্যান্ডস্ক্যাপ ও ইতিহাসকে বাকি পৃথিবীর কাছে ফিল্মের মাধ্যমে তুলে ধরেছেন। তবে আকিরা কুরোসাওয়ার মতো আর কোনো জাপানি ফিল্মমেকার এ কাজটি এখন পর্যন্ত এত ভালোভাবে করতে পারেননি। পাশ্চাত্যে রসোমন শ্রদ্ধা ও ভয় মিশ্রিত বিস্ময়ে সাদর আমন্ত্রিত হওয়ার ৪০ বছর পর সেখানে ড্রিমস্ প্রায় একইরকম আনন্দকে আলিঙ্গন করেছে। আর এ ক্ষেত্রে কুরোসাওয়াকে মনে হয়েছে, তিনি যেন শক্তিমান থেকে শক্তিমানতরো হয়ে উঠেছেন। এই দীর্ঘ যাত্রায় তার ফিল্ম সত্যের কাছ থেকে একটুও দূরে সরে যায়নি।

ওজুকে ‘অতি জাপানি’ বলে বিবেচনা করে যারা বছরের পর বছর ধরে তার প্রতিভা থেকে আমাদেরকে বঞ্চিত করেছেন, সেই জাপানি প্রডিউসারদের সন্দেহগ্রস্ত প্রবণতাকে ধন্যবাদ, পাশ্চাত্যে কুরোসাওয়ার সাফল্য তাদের কাছে এক ধরনের অপ্রত্যাশিত ফল হিসেবে সন্দেহের সঙ্গে বিবেচিত হয়েছিল বলে! বিতর্কোর্ধ্ব সাফল্য সত্ত্বেও কুরোসাওয়া আসলে ছিলেন আন্তর্জাতিক ফিল্মের ইতিহাসের অন্যতম সেরা ঝুঁকিবাজ ফিল্মমেকার। বলে নেওয়া ভালো, এ লাইনে ঝুঁকি অনেকেই নিলেও তার মতো সফল সবাই হননি। নিজের বিশ্বখ্যাত প্রত্যেকটি ফিল্মেই ফর্মের ক্ষেত্রে তিনি অধিক নিরীক্ষাধর্মী থেকেছেন, কিংবা অধিক কঠিনতরো করে এগিয়ে নিয়ে গেছেন বা অনুসরণ করেছেন একেকটি ফিল্মকে। এমন তর্ক ওঠা স্বাভাবিক যে, কুরোসাওয়ার কয়েকটি ভীষণ ব্যবসা-সফল ফিল্ম [রসোমন, ইকিরু, সেভেন সামুরাই] তার ক্যারিয়ারকে ব্যাপক ঝুঁকির মধ্যে ফেলে দিয়েছিল– যার মূল্য তিনি পেয়েছিলেন। শুনতে অবাক লাগবে, তিনি এখন অহরহই [বিশেষ করে জাপানে] স্মরণীয় হয়ে ওঠেন একজন প্রতিক্রিয়াশীল ও পশ্চাৎপদচারি ফিল্মমেকার হিসেবে! অথচ দর্শক যা চায়, সেই অপার্থিব বোধকে পাশ কাটিয়ে একটি অধ্যাবসায়ী নিরীক্ষাধর্মী সুতো ছড়িয়ে আছে এই ফিল্মমেকারের কাজগুলোর পরতে পরতে।

দৃশ্য । ড্রাঙ্কেন অ্যাঞ্জেল
দৃশ্য । ড্রাঙ্কেন অ্যাঞ্জেল

যে ফিল্মগুলোর মাধ্যমে কুরোসাওয়া তার ক্যারিয়ার প্রতিষ্ঠার অন্বেষণ করেছিলেন, সেগুলোকে যদি হিসেবে না ধরা হয়, তাহলে তার প্রথম সণাক্তযোগ্য মাস্টারওয়ার্ক হিসেবে মর্যাদা পাবে ড্রাঙ্কেন অ্যাঞ্জেল। এটি [যুদ্ধপরবর্তী ‘রেড স্কেয়ার’ যুগের] একটি দুঃসাহসিক সামাজিক ডকুমেন্টও। এই ফিল্মে একজন ধর্মযুদ্ধবাদ ডাক্তারের নিরন্তর নিস্ফল প্রচেষ্টার চিত্রাঙ্কনের ভেতরে ইকারুর পূর্বাভাস পাওয়া যায়। ডাক্তার চরিত্রে অভিনয় করা তাকাসি সিমুরাই ইকিরুতে ওয়াতানাবে চরিত্রে অভিনয় করেছেন– যে কিনা টোকিওর একটি বস্তির কোনো এক অনালোকিত প্রান্তে একটি বদ্ধ ডোবার নর্দমায় মশার ডিম খোঁজে। আর তা অনুসৃত হয় একটি মেলোড্রামায়; নাম দ্য কোয়াইট ডুয়েল। এরপর কুরোসাওয়া নির্মাণ করেন স্ট্যারি ডগ। গ্রীষ্মের গরমে টোকিওতে নিজের চুরি যাওয়া পিস্তলের অনুসন্ধান করা এক পুলিশের একটি তাগড়া ও চমৎকার প্রতিকৃতি এটি। এই ফিল্মমেকারের এর পরের কাজটি বরং একটি বিরক্তিকর জাপানি ভাবালুতা; নাম, স্ক্যান্ডাল। কিন্তু তার পরের ফিল্ম রসোমন প্রডিউসারদের কাছে না হলেও, দর্শক ও সমালোচকদের কাছে তার খ্যাতিকে পাকাপোক্ত করে দেয়। এরপর আর পিছু ফিরে তাকাতে হয়নি মাস্টার ফিল্মমেকার কুরোসাওয়াকে।

পনের বছর ও এগারটি ফিল্মের শেষে, এই অন্তবর্তী সময়ে দুয়েকটি ‘সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ ফিল্ম’ [এরমধ্যে একটি হলো সর্বকালের অনন্যসাধারণ ‘পৌরুষদীপ্ত’ ফিল্ম– সেভেন সামুরাই; এ ব্যাপারে দ্বিমত আছে কার?] বানিয়ে কুরোসাওয়া সমালোচনামূলক ও বাণিজ্যিক– দুই ক্ষেত্রেই বিরাট অদৃষ্টপুরুষ হয়ে ওঠেন। এক সময় অবশ্য তিনি তার ক্যারিয়ারের সবচেয়ে অন্ধকারাচ্ছন্ন ও কঠিনতম সময়ে প্রবেশ করেছিলেন। ইয়ুজিম্বো ও সানজুরোর মতো সামুরাই সেটায়ারগুলোর অবসরমুখি ফিল্মমেকার হিসেবে শ্রেণীবদ্ধ হওয়াকে পাত্তা না দিয়ে ১৯৬৫ থেকে ১৯৮৫ সাল পর্যন্ত বানানো তার সবগুলো ফিল্মে [আজব ব্যাপার হলো, এ সময়ে মাত্র পাঁচটি ফিল্ম বানিয়েছেন] তিনি ক্যারিয়ার শেষ করে দেওয়ার মতো শক্তিমান সব জুয়া খেলেছেন। বেশ কয়েকটি ক্রান্তিকালের মধ্যে প্রথমটার মুখোমুখি যখন হয়েছেন, তখন জাপানি ফিল্ম ইন্ড্রাস্ট্রি তার ফিল্মগুলোর প্রতি দেখিয়েছে অত্যন্ত পাষাণ মনোভাব।

দৃশ্য । রশোমন
দৃশ্য । রশোমন

রেড বিয়ার্ড ছিল কুরোসাওয়ার জন্য সময় ও টাকার প্রশ্নে একটি এলাহি বিনিয়োগ [তার অভ্যস্ত নায়ক, ১৬টি ফিল্মের অভিনেতা তসিরো মিফুনের কাছে এই প্রোডাকশনটি হয়ে উঠেছিল এক ধরনের জবরদস্তির মতো। ফলে, দুজনের ঝগড়া বাধে। এরপর কুরোসাওয়ার আর কোনো ফিল্মে কখনোই দেখা যায়নি তাকে।] ফিল্মটি সমালোচকদের প্রশংসা পাওয়া সত্ত্বেও পরের প্রজেক্ট– তা সেটি যে প্রজেক্টই হোক না কেন– পাওয়ার প্রচেষ্টায় এই ফিল্মমেকারকে ব্যয় করতে হয়েছে পাঁচটি বছর। কুরোসাওয়ার প্রথম কালার ফিল্ম– দোদেসকাদেন । এতে একটি স্পর্ধিত স্টাইলকে অর্জন করতে পেরেছেন এই শিল্পী। তবুও বেশিরভাগ জাপানি সমালোচকের কাছ থেকে উপহাস পাওয়ার দুর্ভাগ্য বরণ করতে হয় তাকে। এই ফিল্মের রিসিপশন কুরোসাওয়াকে এতটাই মর্মাহত করেছিলো যে, রীতিমতো আত্মহত্যার চেষ্টা চালিয়েছিলেন তিনি!

রেড বিয়ার্ড-এর সদ্য স্মরণযোগ্য আতিশয্য [অনেকটা স্বেচ্ছায় দুই বছর ধরে ফিল্মটির কাজ করেছেন তিনি; এর ফলে এর অভিনেতা-অভিনেত্রী ও সেটকে তার চাওয়া মতো জীবনযাপন করতে হয়েছে] এবং দোদেসকাদেন-এর বেমানান নিরানন্দের [এ ফিল্মের খামখেয়ালি চরিত্রগুলো একটি আবর্জনার আঁস্তাকুড়ে বসবাস করে] ফলশ্রুতিতে কুরোসাওয়াকে জাপানি প্রডিউসাররা ভীষণ অপব্যায়ী হিসেবে গণ্য করতেন। ফলে পরের ফিল্ম দেরুসু উজালা বানানোর জন্য তাকে সোভিয়েত রাশিয়ায় পাড়ি জমাতে হয়। আরও আরও অ্যাওয়ার্ড ও প্রশংসা পাওয়া সত্ত্বেও কুরোসাওয়ার কাছে ভীষণ ঘনিষ্ঠতা ও দ্রুততার সঙ্গে যা আসছিল, তা হলো– তাকে যেসব প্রডিউসার স্রেফ একজন অপব্যয়ী বাউণ্ডুলে হিসেবে বিবেচনা করতেন, তাদের ক্রুব্ধ হয়ে ওঠা। ফলে, দেরুসু উজালা মুক্তির পরের ছয়টি বছরও তাকে খরায় কাটাতে হয়। শেষ পর্যন্ত কুরোসাওয়ার দীর্ঘদিনের গুণমুগ্ধ, আমেরিকান দুই ফিল্মমেকার ও প্রডিউসার ফ্রান্সিস ফোর্ড কপোলা ও জর্জ লুকাস তার সামনে হাজির হন– একটি ফিল্মে অর্থলগ্নির প্রস্তাব নিয়ে। কুরোসাওয়া স্বভাবজাতভাবে একটি দীর্ঘ-লালিত প্রকল্পের প্রস্তাব রাখেন; নাম, শ্যাডো ওয়ারিয়র। প্রজেক্টটির ব্যাপ-আপ পান তিনি। কিন্তু অবাক করা ব্যাপার হলো, ফিল্মটি সম্পন্ন হওয়ার পর জাপানের প্রাক-তোকুগাওয়া সময়কালের উপর ভিত্তি করে বানানো নিগূঢ় কাহিনিটিকে সম্ভবত আমেরিকান ফিল্ম দর্শকদের অভিভূত করার উপযোগি করে তোলার উদ্দেশে কপোলা ও লুকাস তাদের বহু-প্রশংসিত গুরুকে কিছু অংশ কাট করে দিতে বলে বসেন। এইসব বিদ্রুপাত্মক গুণমুগ্ধদেরকে ঠাণ্ডা করার জন্য কুরোসাওয়া ফিল্মটির ২০ মিনিটের ফুটেজ কেটে বাদ দেন। আর ফিল্মটি এমন হাক-ডাক নিয়ে পাশ্চাত্যে মুক্তি পায়– যা অনুচারি কুরোসাওয়ার আর কোনো ফিল্ম সেই ১৯৬০ দশকের শুরু থেকে আজ পর্যন্ত হতে পারেনি।

দৃশ্য । সেভেন সামুরাই
দৃশ্য । সেভেন সামুরাই

তবুও প্রোডাকশনটির খবর জাপানি প্রডিউসারদের জন্য এতটাই অবমাননাকর ছিল, কুরোসাওয়াকে আবারও বৈদেশিক বিনিয়োগের উপর নির্ভর করতে হয়। এবার করেছেন ফ্রান্সের সার্জ্য সিলবারমান। এটি ছিল নিশ্চিতভাবেই শিল্পী হিসেবে এই ফিল্মমেকারের চূড়ান্ত বিবৃতি– মধ্যযুগীয় জাপানের প্রেক্ষাপটে শেক্সপিয়ারের কিং লিয়ার-এর হৃদয়গ্রাহী ও উলে­খযোগ্য রূপান্তর; নাম রাখলেন রান। ইতালিয়ান কম্পোজার জুজেপ্পে ভের্দির কম্পোজে শেক্সপিয়ারের ওথেলো যে মর্যাদায় দাঁড়িয়েছিল, কুরোসাওয়ার কর্মযজ্ঞে এই ফিল্মটি সে রকম উচ্চতায়ই দাঁড়িয়ে যায়; হয়ে ওঠে তার দর্শনের একটি চূড়ান্ত ও জমকালো বিবৃতি, এবং সাম্প্রতিক সময়ের সবচেয়ে জাগরনী ফিল্মগুলোর অন্যতম।

১৯৮৯ সালে কুরোসাওয়া যখন লাইফটাইম এচিভমেন্ট ক্যাটাগরিতে অস্কার পেলেন [‘একাডেমি’র তরফ থেকে এ আরেক প্যাচালো অ্যাওয়ার্ড; কেননা, তারা কুরোসাওয়ার কোনো ফিল্মকেই তাদের সোনালি মোড়কের ট্রফি দেননি], জাপানিরা তখনই কেবল বুঝতে পারল তাকে। ফলশ্রুতিতে, তিনি পেলেন ন্যাশনাল লিভিং ট্রিজার [জাপানি সরকার কর্তৃক নির্দিষ্ট (বয়ষ্ক) শিল্পীদের জানানো সম্মাননা এটি। বিজয়ীদের পরবর্তী কাজগুলোকে অনুদান দেওয়া হয়, তবে সেগুলো থেকে অর্জিত অর্থের একমাত্র মালিকানা থেকে যায় সরকারের হাতেই।] বুড়ো হওয়ার আগে আরও তিনটি ফিল্ম বানাতে পেরেছিলেন তিনি। এরপর অসুস্থ শরীর তাকে বাধ্য করেছে অবসর নিতে। ড্রিমস্, রাপসোডি ইন আগস্ট ও মাদাদায়ো তার সর্বশেষ এই ফিল্মগুলো কখনোই যুক্তরাষ্ট্রের সিনেমাহলে মুক্তি পায়নি। এগুলো ছিল ব্যক্তিগত ও ধ্যাননিষ্ঠ ফিল্ম; এরা শৈল্পিকভাবে মুক্ত, তবে নিয়ন্ত্রিত এবং একরকম মার্জিত।

কুরোসাওয়ার যে ফিল্মটি এখন পর্যন্ত সবচেয়ে ধারাবাহিকভাবে অবহেলিত হয়ে আছে, সেটির নাম দ্য লোয়ার ডেপথস। [জাঁ রেনোয়ার দ্য লোয়ার ডেপথস-এর (১৯৩৬) একটি ‘রিমেক’ ফিল্ম কুরোসাওয়া বানিয়েছেন বলে কিছু স্থুল ফিল্ম রেফারেন্স গাইডেরা এটিকে ইঙ্গিত করে।] নিজের প্রথম শেক্সপিয়ার-এডাপশন থ্রোন অব ব্লাড-এর পর কুরোসাওয়া উৎসাহিত হয়েছিলেন ম্যাক্সিম গোর্কির নাটক অবলম্বনে ফিল্ম বানানোর; তার তা হয়ে ওঠে একটি গুরুত্বপূর্ণ কীর্তি।

কুরোসাওয়ার যত ‘রূপান্তরিত’ কাজ আছে [যেমন– দ্য ইডিয়ট, থ্রোন অব ব্লাড, হাই অ্যান্ড লো ও রান], তার মধ্যে দ্য লোয়ার ডেপথস্ সবচেয়ে ফলপ্রসূ। এর কারণটা খুবই সাদামাটা : কর্মপরিধিতে অতটা উচ্চাকাঙ্ক্ষী নয় এটি। দ্য ইডিয়ট ভুলপথে অতি-আক্ষরিক; হাই অ্যান্ড লো একটি নিন্মমানের গল্পকে রহস্য-উন্মোচক আধুনিক নীতিগল্প করে তুলতে শেষ পর্যন্ত [তবে অসাধারণভাবে] ব্যর্থ হয়েছে; শেক্সপিয়ারের অ্যাডাপশনগুলো [থ্রোন অব ব্লাড ও রান] হৃদয়গ্রাহী ও গুরুত্বপূর্ণ কাজ হয়ে উঠলেও কবিতার অনুপস্থিতিকে উপযুক্ত প্রাণবন্ত ইমাজারির মাধ্যমে প্রতিস্থাপন করার ক্ষেত্রে কখনো কখনো ভীতিকর প্রচেষ্টায় টলোমলো হয়ে উঠেছে। দ্য লোয়ার ডেপথস্-এর মাধ্যমে কুরোসাওয়া এমন একটি পথকে খুঁজে পান, যেটি অনেক বিশিষ্ট ফিল্মমেকারের কাছে ধরা দেয়নি; যেমন, মাধ্যমের সঙ্গে কোনো রকম বিশ্বাসঘাতকতা না করে একটি মঞ্চনাটককে ফিল্মে রূপান্তর করার উপায়। উপরের আলোকিত পৃথিবীর স্রেফ ক্ষণজীবী আভাস দিতে গিরিপ্রান্তের তলদেশের এক কুঁড়ে ঘরের সংকীর্ণ পরিবেশে পুরো সেট ফেলে [মনে হয়েছে, ওপেনিং শট থেকেই তিনি শিরোনামটিকে আক্ষরিকভাবে অলংকৃত করতে বদ্ধপরিকর] ‘নাটুকেপনা’র দায়িত্ব নেওয়ার ক্ষেত্রে কুরোসাওয়া নির্ভীকভাবে ধাঁধা লাগিয়ে দিয়েছেন– পরিপ্রেক্ষিতের প্রতিনিয়ত পরিবর্তন ঘটানোর মাধ্যমে, অ্যাকশনের ও একটি সুস্পষ্টভাবে প্রবাহমান নাটকীয় অভিনয়ের ক্ষেত্রে সূক্ষ্মভাবে ইন্টারকাটিং অল্টারনেটিং একটি বুনোট বেষ্টনির মধ্যে মাল্টিপল ক্যামেরাগুলোকে ব্যবহারের ক্ষেত্রে তার স্বভাবগগত সুযোগ নেওয়ার মাধ্যমে। ৪০ দিন রিহার্সেলের পর মাত্র তিনদিন শুটিং করার মাধ্যমে কুরোসাওয়া তার জমকালো অভিনেতাদলকেই চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিতেন স্রেফ বিস্তৃত শটের মাধ্যমেই নয়, বরং অ্যাকশনটির একটি সম্পৃক্ততার ও ক্যামেরা অ্যাঙ্গেলের মধ্যে একটি অপ্রতিরোধ্য সংযুক্তির মাধ্যমেও; নিজেদের পারফরমেন্সের যেখানে তাদের নজর দেওয়া দরকার– তা তাদের সবাইকে ঠিক সেই ভারসাম্য দান করত

দৃশ্য । দ্য লোয়ার ডেপথস
দৃশ্য । দ্য লোয়ার ডেপথস

গোর্কির নাটক একটি বিভ্রান্তিময় [আন্তন] চেখভিয়ান স্টাইলের মধ্যে মানবতার পর্যুদস্ত হওয়ার [ফিওদর] দস্তোয়েভস্কিয়ান একটি পরিস্থিতিকে উপস্থাপন করে। চরিত্রগুলো তাদের পুরোটা সময় ব্যয় করে হয় অজানায় দূর কোনো ‘উন্নত জীবনে’ পালানোর জন্য, নয়ত এ ধরনের জীবনযাপনকে আখ্যায়িত করে তুচ্ছ ও অলীক হিসেবে। এর অভিনেতারা নিজের জন্য ‘বিষ’ হিসেবে বিবেচনা করে যেটিকে, সেই মাদকই তাদের কাছে পালানোর একমাত্র সঙ্গী; আর শেষদৃশ্যে, যেখানে টিকে থাকা প্রজারারা [নাগরিকেরা] পানাহারের দোহাইয়ে কোনো রকম বাধ্যযন্ত্র ছাড়াই একটি উচ্ছ্বসিত মিউজিক্যাল পিসের পরিবেশনা করে স্রেফ তাদের কণ্ঠ দিয়ে– সেটির সহসাই সমাপ্তি ঘটে অভিনেতাটির আত্মহত্যার খবর আসার মধ্য দিয়ে। ‘ইডিয়ট!’ –জুয়াড়ি বিড়বিড় করে ওঠে, ‘মজাটা নষ্ট করে দিলো সে!’

ব্যাপারটি বিস্ময়কর নয় যে, সাধারণ দর্শকদের কাছে ফিল্মটি সর্বসম্মতভাবে অনেকটা বোধাতীত হয়ে উঠেছে। আর যদিও এটির খ্যাতি যুগের পর যুগ ধরে বেড়ে চলেছে; তবু দ্য ফিল্মস অব আকিরা কুরোসাওয়া গ্রন্থের রচয়িতা ডোনাল্ড রিচির কাছে বৃহতার্থে এটি তারিফের উর্ধ্বেই রয়ে গেছে। সমালোচকেরা একজন ফিল্মমেকারের কাজের জন্য কুঠুরি খুলতে উদ্বিগ্ন বলেই সঠির খাঁজ খুঁজে পাওয়ার জন্য দ্য লোয়ার ডেপথস্কে কঠিন সময় পাড়ি দিতে হয়েছে। তবে এটির নির্মাতার মতো এটিও শ্রেণীভুক্তিকরণকে করেছে থোড়াই কেয়ার।


সূত্র : সেন্সেস অব সিনেমা । ফিল্ম জার্নাল । অস্ট্রেলিয়া
ড্যান হার্পার : আমেরিকান লেখক, পর্যটক, ব্লগার ও সিনেপ্রেমি। বর্তমানে ফিলিপিন বাসিন্দা

ff_Akira Kurosawa-3

আকিরা কুরোসাওয়ার ফিল্মোগ্রাফি 

১৯৪৩    সানশিরো সুগাতা [Sugata Sanshirō]
১৯৪৪    দ্য মোস্ট বিউটিফুল [Ichiban utsukushiku]
১৯৪৫    সানশিরো সুগাতা– পার্ট-টু [Zoku Sugata Sanshirō]
           দ্য মেন হু ট্রিড অন দ্য টাইগার’স টেইল [Tora no o wo fumu otokotachi]
১৯৪৬    নো রিগ্রেটস ফর আওয়ার ইয়ুথ [Waga seishun ni kuinashi]
১৯৪৭    ওয়ান ওয়ান্ডারফুল সানডে [Subarashiki nichiyōbi]
১৯৪৮    ড্রাঙ্কেন অ্যাঞ্জেল [Yoidore tenshi]
১৯৪৯    দ্য কোয়াইট ডুয়েল [Shizukanaru kettō]
           স্ট্রে ডগ [Nora inu]
১৯৫০    স্ক্যান্ডাল [Sukyandaru (Shūbun)]
রশোমন [Rashōmon]
১৯৫১    দ্য ইডিয়ট [Hakuchi]
১৯৫২    ইকিরু [Ikiru]
১৯৫৪    সেভেন সামুরাই [Shichinin no samurai]
১৯৫৫    আই লিভ ইন ফিয়ার [Ikimono no kiroku]
১৯৫৭    থ্রোন অব ব্লাড [Kumonosu-jō]
দ্য লোয়ার ডেপথস [Donzoko]
১৯৫৮    দ্য হিডেন ফরট্রেস [Kakushi toride no san akunin]
১৯৬০    দ্য ব্যাড স্লিপ ওয়েল [Warui yatsu hodo yoku nemuru]
১৯৬১    ইয়োজিম্বো [Yōjinbō]
১৯৬২    সানজুরো [Tsubaki Sanjūrō]
১৯৬৩    হাই অ্যান্ড লো [Tengoku to jigoku]
১৯৬৫    রেড বিয়ার্ড [Akahige]
১৯৭০    দোদেসুকাদেন [Dodesukaden]
১৯৭৫    দেরসু উজালা [Derusu Uzāra]
১৯৮০    কাগেমুশা [Kagemusha]
১৯৮৫    রান [Ran]
১৯৯০    ড্রিমস্ [Yume]
১৯৯১    র‌্যাপসোডি ইন অগাস্ট [Hachigatsu no rapusodī]
১৯৯৩    মাদাদায়ো [Mādadayo]

Print Friendly, PDF & Email
সম্পাদক: ফিল্মফ্রি । ঢাকা, বাংলাদেশ।। সিনেমার বই [সম্পাদনা/অনুবাদ]: ফিল্মমেকারের ভাষা [৪ খণ্ড: ইরান, লাতিন, আফ্রিকা, কোরিয়া]; ফ্রাঁসোয়া ত্রুফো: প্রেম ও দেহগ্রস্ত ফিল্মমেকার; তারকোভস্কির ডায়েরি; স্মৃতির তারকোভস্কি; হিচকক-ত্রুফো কথোপকথন; কুরোসাওয়ার আত্মজীবনী; আন্তোনিওনির সিনে-জগত; কিয়ারোস্তামির সিনে-রাস্তা; সিনেঅলা [৪ খণ্ড]; বার্গম্যান/বারিমন; ডেভিড লিঞ্চের নোটবুক; ফেদেরিকো ফেল্লিনি; সাক্ষাৎ ফিল্মমেকার ফেদেরিকো ফেল্লিনি; সাক্ষাৎ ফিল্মমেকার ক্রিস্তফ কিয়েস্লোফস্কি; সাক্ষাৎ ফিল্মমেকার চান্তাল আকেরমান; সাক্ষাৎ ফিল্মমেকার বেলা তার; সাক্ষাৎ ফিল্মমেকার নুরি বিলগে জিলান; ক্রিস্তফ কিয়েস্লোফস্কি; বেলা তার; সের্গেই পারাজানোভ; ভেরা খিতিলোভা; সিনেমা সন্তরণ ।। কবিতার বই: ওপেন এয়ার কনসার্টের কবিতা; র‍্যাম্পমডেলের বাথটাবে অন্ধ কচ্ছপ; হাড়ের গ্যারেজ; মেনিকিনের লাল ইতিহাস ।। মিউজিকের বই [অনুবাদ]: আমার জন লেনন [মূল : সিনথিয়া লেনন]; আমার বব মার্লি [মূল: রিটা মার্লি] ।। সম্পাদিত অনলাইন রক মিউজিক জার্নাল: লালগান

12 মন্তব্যগুলো

মন্তব্য লিখুন

Please enter your comment!
Please enter your name here