শেখ নিয়ামত আলীর গদ্য । চলচ্চিত্রে শব্দের ভূমিকা

539

গ্রন্থ : প্রেক্ষাপট : বিশ্ব চলচ্চিত্র। সম্পাদক : মাহবুব জামিল। প্রকাশক : অনুষ্টুপ চলচ্চিত্র সংসদ। দ্বিতীয় পর্যায় : ডিসেম্বর ১৯৭৬। প্রচ্ছদ : নিতুন কুণ্ডু। পৃষ্ঠা সংখ্যা : ১৩৬। মূল্য : ছয় টাকা

লিখেছেন শেখ নিয়ামত আলী

প্রতি দশকে নতুন নতুন পরীক্ষা-নিরীক্ষার ভেতর দিয়ে চলচ্চিত্রে জন্ম নিচ্ছে এমন সব প্রয়োগ ভাষা, যেগুলো বাস্তবিকই এ শিল্পকে দিন দিন জীবন্ত ও সৃজনশীল করে চলছে। কিন্তু এটাও সত্য, আজ যেটা উৎকৃষ্ট প্রয়োগ ভাষা হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে বা গুরুত্ব পাচ্ছে_ হয়তো, আগামী দশকে সে ভাষার প্রয়োগে ততটুকু উৎকর্ষ খুঁজে না পাবার জন্যে, তা কম গুরুত্ব সহকারে ব্যবহৃত হতে পারে। তবে ভাষার গুরুত্বের তারতম্য থাকলেও, চলচ্চিত্রের প্রয়োগ ভাষাকে বাস্তবতাময় ও শিল্পসম্মত করে তুলতে যে সকল উপাদানের একান্ত প্রয়োজন, তার মধ্যে অপটিকস ও সাউন্ডের ভূমিকা প্রধান। এ দুটো উপাদান একে অপরের সঙ্গে সম্পৃক্ত। যদিও দৃশ্য ছাড়া শুধু শব্দের কথা চিন্তা করা বাতুলতা মাত্র; তথাপি চলচ্চিত্রের বাস্তবতায় শব্দের নিজস্ব ভূমিকা সম্বন্ধে আলাদা করে কিছু বলার বিশেষ দরকার আছে।

দি জাজ সিংগার । অ্যালান ক্রসল্যান্ড, গর্ডন হলিংসহেড। যুক্তরাষ্ট্র; ১৯২৭
দি জাজ সিংগারঅ্যালান ক্রসল্যান্ড, গর্ডন হলিংসহেডযুক্তরাষ্ট্র; ১৯২৭

বিশ দশকের কথা বলছি যখন শিল্পগত বিচারে চলচ্চিত্রে শব্দের কোনো স্থান নেই; তখন সবটাই দৃশ্যগ্রাহ্য বা দৃশ্যমান নির্বাক ছবি। কিন্তু বিশ দশকের শেষার্ধ্বে দি জাজ সিংগার ছবির মাধ্যমে সর্বপ্রথম শব্দময় সংলাপের সংযোজন ঘটলে– ছবি সবাক হয়। প্রারম্ভিক সবাক যুগে সংলাপ ছাড়া ছবিতে শব্দের নিজস্ব কোনো ভূমিকা নেই। এ রীতি অবশ্য তিরিশ দশকের শেষাবধি চলচ্চিত্রে পুরাদমে চলতে থাকে। এবং চল্লিশ দশকের গোড়ার দিকেও কিছু কিছু ছবি যে শব্দকে গ্রাহ্য না করে চলেছে– তা লক্ষ্য করা গেছে। অবশ্য শব্দকে অগ্রাহ্য করার মূল কারণ হচ্ছে : সেকালের চলচ্চিত্রকারদের খানিকটা খামখেয়ালি ও একরোখা মনোভাব; এবং খানিকটা আবার শব্দের শৈল্পিক প্রয়োগ সম্বন্ধে তাঁদের জ্ঞানের নিতান্ত অভাব। চলচ্চিত্রকারদের এরূপ রূগ্ণ মনোভাব অবশ্য বেশিদিন টিকে থাকতে পারেনি। পঞ্চাশ দশকের প্রথমার্ধ্বে তা পুরোপুরি নির্বাসিত হয়।

শব্দের বিশেষ বিশেষ প্রয়োগে চলচ্চিত্র এক অতি বলিষ্ঠরূপ নিয়ে শিল্পের অঙ্গনে আজ আলো বিকিরণ করছে। এ কথা অতি সত্য যে, আধুনিক চলচ্চিত্র আজ শুধু দৃশ্যের ওপর নির্ভরশীল নয়, শব্দের ওপরও আস্থাশীল। দৃশ্য ও শব্দ আধুনিক চলচ্চিত্রে একান্ত অপরিহার্য। কাহিনীর উপস্থাপনে ও তার বক্তব্য প্রকাশে, অনুভূতির বিস্তারে বা আবেগ সঞ্চারের ক্ষেত্রে দৃশ্যের সঙ্গে শব্দের সামঞ্জস্যের বিশেষ প্রয়োজন আছে। কারণ দর্শক আজ সজাগ। তারা সিনেমা দেখে শ্যেনদৃষ্টি নিয়ে এবং খরগোশের মতো দু’কান খাড়া করে

চল্লিশ দশকের আগের ছবিতে দেখেছি, নায়িকার হয়তো ভীষণ রাগ হয়েছে, সে সজোরে ঘরের দরজা ঠেলে বেরিয়ে যাচ্ছে; বা একটা ঘোড়া ছুটছে; অথবা সৈনিকরা মার্চ করে সীমান্তের যাচ্ছে– ইত্যাদি দৃশ্য। নায়িকার যে ভীষণ রাগ হয়েছে, দর্শকরা তা উপলব্ধি করতে পাচ্ছেন, তার দরজা ঠেলে বেরিয়ে যাবার মধ্যে। কিন্তু ছবিটি যদি সত্তর দশকে তৈরি হতো– তাহলে দর্শকরা কি স্বাভাবিকভাবে তা গ্রহণ করবেন? তারা কি একটু আলোচনা বা সমালোচনা করবেন না? নায়িকাটি সজোরে দরজা ঠেলে বেরিয়ে গেল, কিন্তু দরজার শব্দ কোথায়? ঘোড়াটি ছুটছে, কিন্তু খুরের শব্দ হচ্ছে না কেন? সৈনিকদের বুটের শব্দ নেই– কারণ কী? এরূপ শত জিজ্ঞাস্য তাঁদেরকে নিশ্চয় ভাবিত করবে। তাঁরা হয়তো চেঁচামেচি করবেন, আসন ভাঙতে উদ্যত হবেন, কেউ কেউ হয়তো ভেঙেও ফেলবেন। কিন্তু শব্দ সংযোজিত ছবি দেখে আজ দর্শকরা তা নিশ্চয় করেন না। বরঞ্চ তাঁরা অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে দেখেন ও শোনেন। আধুনিক চলচ্চিত্রে দৃশ্য ও শব্দের সামঞ্জস্যে তাঁরা খুঁজে পেয়েছেন আত্মতৃপ্তি।

শব্দ ও দৃশ্যের সুষ্ঠু প্রয়োগের গুণে দিন দিন আধুনিক চলচ্চিত্র খ্যাতিমান চলচ্চিত্রকারের হাতে যেন আরও বেশি সৃষ্টিশীল, অসীম সম্ভাবনাময় ও অনেক বেশি বক্তব্য প্রধান হয়ে উঠেছে। এ প্রসঙ্গে বিশ্ববিখ্যাত চলচ্চিত্রকার পুদোভকিনের উক্তির কথা মনে পড়ে গেল :

“The sound film is a new medium which can be used in entirely new way. Sounds and human speech should be used by the directors not as a literal accompaniment but to amplify and enrich the visual image on the screen. Under such conditions could the sound film become a new form of art whose future development has no predictable limits.”

পয়ত্রিশ-ছত্রিশ বছর আগে এক সৃজনশীল শিল্পীর ভবিষ্যৎবাণী আজ বাস্তবে রূপায়িত হচ্ছে। সাউন্ডট্রাকিং যন্ত্রের সাহায্যে প্রচণ্ড বোমা বর্ষণের শব্দ থেকে শরু করে ঘড়ির মৃদু টিকটিক শব্দটি পর্যন্ত, ঠিক যতটুকু প্রয়োজন– ততটুকুই শ্রবণগ্রাহ্য করে দর্শকের কানে পৌঁছে দিচ্ছে। ফলে দৃশ্যের সাথে শব্দের নিখুঁত প্রয়োগে দর্শকের নিকট ছবি অর্থবহ হয়ে উঠছে। এখানে তুলনামূলকভাবে আরও একটা কথা বলা দরকার। একজন অঙ্কনশিল্পী বা সাহিত্যিক যেমন তুলির আঁচড়ে বা কলমের ডগায় তাঁর সব চিন্তা-ভাবনা বা অনুভূতিকে তুলে ধরতে পারেন, তেমনি একজন সৃজনশীল পরিচালকও সেগুলো ক্যামেরা এবং সাউন্ডের সাহায্যে সেলুলয়েডের ফিতেয় ধরে রাখতে পারেন বলে– তাঁর ছবি বাস্তব ও শিল্প সুষমামণ্ডিত হয়ে উঠছে।

নিম্নে কয়েকজন বিশ্ববরেণ্য চলচ্চিত্রকারের নির্মিত ছবির কয়েকটা উল্লেখযোগ্য ‘দৃশ্য’ উদাহরণস্বরূপ উপস্থাপন করছি, যেগুলো খুব ভালো সম্পাদনা এবং প্রশংসনীয় চিত্রগ্রহণ সত্ত্বেও সাউন্ড এফেক্টের কাছে নতি স্বীকার করেছে। অর্থাৎ সাউন্ড সব কিছুর ঊর্ধ্বে প্রশংসিত হয়েছে।

লেটার নেভার সেন্ট । মিখাইল কালাতোজভ । সোভিয়েত-রাশিয়া; ১৯৫৯
লেটার নেভার সেন্ট । মিখাইল কালাতোজভ । সোভিয়েত-রাশিয়া; ১৯৫৯

১। রাশিয়ার মিখাইল কালাতোজভ পরিচালিত দি লেটার দ্যাট ওয়াজ নট সেন্ট [‘লেটার নেভার সেন্ট’– ফিল্মফ্রি] ছবির কথা ধরা যাক। এ ছবির এক জায়গায় দৃশ্য ও শব্দের উল্লেখ করছি, যা দর্শককে ভীষণভাবে আকৃষ্ট করেছে। তাতিয়ানা সামোইলোভা ও ইনোকেন্তি স্মোকতুনোভস্কি মূল্যবান ধাতব পদার্থ পাবার সন্ধানে মাটি খনন করছে। মাটি কাটা যন্ত্রের [শাবল জাতীয়] খটখট শব্দ শোনা যাচ্ছে। হঠাৎ খনন কার্যের মধ্যে ইনোকেন্তি আড়চোখে তাতিয়ানাকে এমনভাবে দেখছে যে দর্শকের নিকট তার দুর্বল চাহনির অভিপ্রায় স্পষ্ট ধরা পড়ছে। সে তখনো আড়চোখে তাতিয়ানাকে লোলুপদৃষ্টিতে দেখছে এবং আস্তে আস্তে যন্ত্রের ঘা মারছে মাটিতে। দুজনে ভীষণ ক্লান্ত। তারা ঘর্মাক্ত। ক্রমশঃ ইনোকেন্তির মনে কামপ্রবৃত্তি চরিতার্থ করার বাসনা উঁকি মারলে_ হাতের যন্ত্রের শব্দ হৃদয়ের ধুক-ধুকুনিতে পরিণত হয় এবং সে শব্দ এতো জোরে হতে থাকে, যেন হাতুড়ি দিয়ে তার অন্তরে কে ঘা মারছে। এসব দৃশ্যে সাউন্ডের অদ্ভুত প্রয়োগে ছবির ইমেজে এমন বিস্ময়কর এফেক্ট সৃষ্টি করেছে যা ছবিটিকে শিল্পগত উৎকর্ষে উন্নীত করে আর্টের ব্যাখ্যায় সাফল্যমণ্ডিত করে তুলেছে।

২। ভারতীয় চলচ্চিত্রকার সত্যজিৎ রায় তাঁর ছবিগুলোতে শব্দের প্রয়োগ করেছেন নানাভাবে। গুপী গাইন বাঘা বাইন ছবিতে গুপীনাথ গাধার পিঠে চড়ে মাহারাজ কর্তৃক দরবার থেকে বিতাড়িত হয়ে এক বটবৃক্ষের তলে বাঘা বাইনের সঙ্গে যখন তার প্রথম পরিচয় হয়, সেই মুহূর্তের কথা ধরুন। গুপীনাথ চলছে মনের দুঃখে। হঠাৎ সে শুনতে পায়, টপটপ করে কিসের ওপর যেন বৃষ্টির ফোঁটা পড়ছে। যতই সে এগিয়ে যাচ্ছে, শব্দ ততই জোরে হচ্ছে। দ্যাখা গেল– গাছের পাতা থেকে বৃষ্টির ফোঁটা বাঘার ঢোলের ওপর টপটপ করে পড়ছে। মনে হচ্ছে, ঢোলের ওপর কে যেন বাড়ি মারছে। অর্থাৎ পাশেই যে বায়েন শুয়ে আছে এটা তার ইঙ্গিত। ফ্যান্টাসি ছবির ক্ষেত্রে এরূপ শব্দের প্রয়োগ ভীষণ আনন্দের সঞ্চার করে। ছবি চলাকালে ছোট-খাটো দৃশ্যে শব্দের গুরুত্ব উপলব্ধি করলে বেশ আনন্দ পাওয়া যায়। সত্যজিৎ রায়ের আর একটা ছবি ‘জলসাঘর’। এ ছবিতে জমিদার বিশ্বম্ভর রায়ের মৃত্যুর দৃশ্যে ভোরবেলা সূর্যের স্নিগ্ধ আলো পড়েছে পৃথিবীতে। উন্মত্ত বেগে ধাবমান প্রিয় অশ্বের পৃষ্ঠে বিশ্বম্ভর রায় মৃত্যুকে আলিঙ্গন করলেন। সেই শেষ মুহূর্তগুলোতে ঘোড়ার খুরের ক্রমবর্ধমান শব্দ, ঘোড়া থেকে পড়ে মাটিতে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করা– কার না মনে বেদনার উদ্রেক করে? শব্দের উপযুক্ত প্রয়োগে ক্ষয়িষ্ণু জমিদারের মৃত্যুর প্রকৃত রূপ ফুটে উঠেছে।

৩। পোল্যান্ডের পরিচালক আন্দ্রিয়েই ভাইদা, তার অ্যাশেজ অ্যান্ড ডায়মন্ডস ছবিতে গুলিবিদ্ধ নায়ক মাচিয়েকের পলায়নপর হৃদয়বিদারক যে দৃশ্য রচনা করেছেন তা দর্শকের অন্তরে গভীরভাবে নাড়া দিয়েছে। এ সিকোয়েন্সে তিনি দেখাচ্ছেন যন্ত্রণায় অস্থির মাচিয়েক বাঁচার বৃথা চেষ্টা করছে। তার ভেতর থেকে অস্ফুটে একটা ভয়ঙ্কর বিকট শব্দ এমনভাবে বেরিয়ে আসছে, যা মৃত্যুকে স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে। বিকট শব্দ করতে করতে খোলা অসমতল মাঠের ওপর দিয়ে সে ছুটছে। এক ঝাঁক কাক কর্কশ ধ্বনি দ্বারা আসন্ন মৃত্যুর ইঙ্গিত দিয়ে যায়। মাচিয়েক আর চলতে পাচ্ছে না, পড়ে যায় নিক্ষিপ্ত আবর্জনার মধ্যে এবং এখানেই সে আহত কুকুরের মতো গোঙাতে গোঙাতে মুখ গুজে মরে যায়। দৃশ্যের সঙ্গে শব্দের এমন সাযুজ্য থাকায় তা নিতান্ত উদাসীন দর্শকের মনেও জাগিয়ে তোলে গভীর বেদনা ও সহানুভূতি।

সেভেন্থ সীল । ইঙ্গমার বার্গম্যান । সুইডেন; ১৯৫৭
সেভেন্থ সীল । ইঙ্গমার বার্গম্যান । সুইডেন; ১৯৫৭

৪। সুইডিশ পরিচালক ইঙ্গমার বেয়ারিমানের ছবি সেভেন্থ সীল-এ ছবির প্রথম দৃশ্যের শব্দ সম্বন্ধে কিছু বলার দরকার। ছবিটি শুরু হয়, বিপদ সঙ্কেত ধ্বনি দিয়ে। শূন্য আকাশে একটা গাংচিল উড়ছে। দূরে পর্বতমালা দৃশ্যমান। আকাশে মেঘের ঘনঘটা। একটা থমথমে করুণভাব চারদিকে বিরাজমান। এরূপ দৃশ্যের মধ্যে একটানা করুণ শব্দ দর্শকের কানে ভেসে আসছে। এবার সমস্বরে সমবেত কণ্ঠে বাইবেলগীত শোনা যায় এবং সেই সঙ্গে দৃশ্যমান হচ্ছে ধর্মের পবিত্র ভূমিতে দীর্ঘদিন অতিবাহিত করে একজন নাইট ও তার সঙ্গী সুইডেন ফিরছেন। প্লেগে অরহর মৃত্যু, ঈশ্বরের অস্তিত্ব সম্বন্ধে নাইটকে সন্দিহান করে তোলে। ধর্মযুদ্ধ সম্বন্ধে তাঁর ধারণা এবার একদম বদলে গেছে। সে এখন অন্তর্দ্বন্দ্বে বিদগ্ধ। এ হলো সমগ্র দৃশ্যটির রূপ। এখানে উচ্চশব্দ বিশিষ্ট বাইবেলগীত নাইটের মানসিকতাকে অস্থির করে তুলেছে। যে কোনো তীক্ষ্ণ শব্দ যেমন মানুষকে সজাগ করে দেয়– কি হয়েছে তা জানার প্রশ্নে। এখানে চলচ্চিত্রকার শব্দের এ ধ্বনির দ্বারা দর্শককে সজাগ করতে চাচ্ছেন এজন্যে যে নাইট ধর্ম সম্বন্ধে ভীষণ সচেতন। সুতরাং তাঁকে জোরে জোরে ধর্মীয়গীত শোনানোর অর্থ, লোক দেখানো ধর্মের প্রতি একটা অবিশ্বাস জন্মানো যা বিদ্রূপাত্মক হিসেবে এখানে ধ্বনিত হয়েছে। শব্দের পারফেক্ট প্রয়োগে এ সব দৃশ্য বাস্তবতার এর চরম পর্যায়ে উপনীত হয়েছে, যা ছবিটিকে বক্তব্য প্রধান করে তুলেছে।

৫। ইতালির দি সিকা পরিচালিত বাইসাইকেল থিভস ছবির নায়ক আন্তোনিওর মনের আশা-আকাঙ্ক্ষা, ব্যথা-বেদনা, হতাশা, আবেগ বা অনুভ‚তির সব কিছুই তার পারিপার্শ্বিকতার মধ্যে স্পষ্টভাবে ফুটে উঠেছে। শহরের রাজপথে মানুষের চেঁচামেচির শব্দ, চলমান গাড়ির শোঁ-সাঁ শব্দ, খেলার মাঠের হৈ-চৈ শব্দ, কারখানার যন্ত্রপাতির টুংটাং শব্দ, চায়ের দোকানের কাপ-পিরিচ-গ্লাসের ঠুংঠাং শব্দ ইত্যাদি সবই যেন আন্তোনিওর জীবনের সঙ্গে একাত্মতা ঘোষণা করেছে। দৃশ্যের সঙ্গে শব্দের সাঙ্ঘাতিক মিল থাকায় ‘বাইসাইকেল থিভস’ এমন প্রাণস্পর্শী ও জীবননিষ্ঠ ছবি হতে পেরেছে, যা এ যুগের অন্যতম শিল্পকীর্তি হিসেবে স্বীকৃত।

বর্তমানে প্রাচ্য ও প্রতীচ্যের সেরা চলচ্চিত্রকারগণ শব্দের গুরুত্ব উপলব্ধি করছেন। অপটিকস ও সাউন্ড নিয়ে তারা মাথা ঘামাচ্ছেন। শব্দের সুষ্ঠু প্রয়োগ ব্যতীত ছবি যে বাস্তবতাবর্জিত হয়, তা তাঁরা বুঝতে পারছেন। পুদোভকিন আজ সকলের শ্রদ্ধাভাজন।

সূর্যকন্যা । আলমগীর কবির । বাংলাদেশ; ১৯৭৫
সূর্যকন্যাআলমগীর কবিরবাংলাদেশ; ১৯৭৫

এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশের ছবির কথা তুলে লজ্জা পেতে চাইনে। কারণ বাংলাদেশের অধিকাংশ ছবিতে শব্দের নিষ্করুণ অনুপস্থিতি বিদ্যমান। দু’দশক অতিক্রান্ত বাংলাদেশের ছবিগুলোর মধ্যে জহির রায়হানের আনোয়ারা, সুভাষ দত্তের অরুণোদয়ের অগ্নিস্বাক্ষী, মিতার লাঠিয়াল, কবীর আনোয়ারের সুপ্রভাত এবং আলমগীর কবীরের সূর্যকন্যা ছবিতে শব্দের মোটামুটি প্রয়োগ লক্ষণীয়।

উপসংহারে একটা কথা বলে শেষ করছি : ‘শব্দ’ আধুনিক চলচ্চিত্রের প্রাণ। শিল্পসম্মত চলচ্চিত্র সৃষ্টির জন্যে শব্দ ও তার সুষ্ঠু প্রয়োগ একান্ত অপরিহার্য। সুতরাং ভালো ছবি নির্মাণের জন্যে দৃশ্যের সঙ্গে শব্দের ভূমিকা অনস্বীকার্য।

Print Friendly, PDF & Email
শেখ নিয়ামত আলী। মাস্টার ফিল্মমেকার। বাংলাদেশ।। জন্ম : ৩০ এপ্রিল ১৯৩৯; চব্বিশ পরগনা, পশ্চিমবঙ্গ, ভারত [তৎকালীন 'ব্রিটিশ-ইন্ডিয়া'। মৃত্যু : ২৪ নভেম্বর ২০০৩; ঢাকা, বাংলাদেশ। ফিল্ম : সূর্যদীঘল বাড়ী [যৌথ-নির্মাণ; ১৯৭৯]; দহন [১৯৮৬]; অন্য জীবন [১৯৯৫]। অ্যাওয়ার্ড : শ্রেষ্ঠ পরিচালক [বাংলাদেশ জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার; ১৯৭৯, ১৯৮৬, ১৯৯৫]

3 মন্তব্যগুলো

  1. […] Milieu, যেমনটি পরবর্তীতে আমরা কিছুটা দেখব শেখ নিয়ামত আলীর দহন-এও। কলেজের চাকুরিটার কী হলো– […]

মন্তব্য লিখুন

Please enter your comment!
Please enter your name here