পিটার উইয়ার । অস্ট্রেলিয়ান নিউ ওয়েভের অগ্রদূত

289

পিটার উইয়ার। পুরো নাম, পিটার লিন্ডসে উইয়ার। অস্ট্রেলিয়ান মাস্টার ফিল্মমেকার। অস্ট্রেলিয়ান নিউ ওয়েভ [১৯৭০-১৯৯০] ফিল্ম মুভমেন্টের অগ্রদূত। মিস্টেরি ড্রামা পিকনিক অ্যাট হ্যাংগিং রক, সুপারন্যাচারাল থ্রিলার দ্য লাস্ট ওয়েভ ও হিস্টোরিক্যাল ড্রামা গ্যালিপলির মতো মাস্টারপিস ফিল্ম নির্মাণের মাধ্যমে, ১৯৭০ ও ’৮০ দশকে, অস্ট্রেলিয়ান সিনেমার পুনর্জন্মে নেতৃত্বস্থানীয় ভূমিকা পালন করেছেন। নিজ দেশের রাজধানী সিডনির ভাক্লুজ নামের শহরতলির একটি হারবার বা পোতাশ্রয়ের পাশে, ১৯৪৪ সালের ২১ আগস্ট জন্ম তার। বেড়েও উঠেছেন সেই হারবারের আলো-ছায়ায়। অল্প বয়সে, রিয়েল স্টেট এজেন্ট পিতার কাছে সিনেমার গল্প শুনে, এ রাস্তার প্রতি আগ্রহী হয়ে ওঠেন। শিল্প ও সাহিত্যমনা বাবা এক সময় রেডিও নাটকও লিখেছেন; আর ঘুমিয়ে পগার আগে, শিশু পিটারকে হাজারও গল্প শুনিয়ে, তার মনে গেথে দিয়েছেন শিল্পের বীজ।

সিডনি ইউনিভার্সিটিতে আর্টস ও ল’-এ পড়াশোনা শুরুর আগে, স্কটস কলেজ ও ভাক্লজ বয়েজ হাই স্কুলের গণ্ডি পেরিয়েছেন পিটার। বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে এসে, ফিল্মের প্রতি টান আরও বেড়ে যায় সহপাঠী ফিলিপ নয়সি [অস্ট্রেলিয়ান ফিল্মমেকার] এবং পরবর্তী সময়ে সিডনির এক্সপেরিমেন্টাল ফিল্মমেকিং কালেকটিভ– ইউবিইউ ফিল্মস-এর সদস্য হয়ে ওঠা বন্ধু-বান্ধবদের সঙ্গ পেয়ে। এ সময়ে আমেরিকান ফিল্মমেকার স্ট্যানলি কুব্রিকের ফিল্মগুলো তাকে ভীষণ রকম অনুপ্রাণিত করতে থাকে। ১৯৬৫ সালে, পড়াশোনা ছেড়ে দিয়ে, এক বছর ধরে, ইউরোপের নানাপ্রান্তে ঘুরে কাটান তিনি। এ সময়েই ওয়েন্ডি স্টাইটসের সঙ্গে পরিচয় ঘটে। বলে রাখা ভালো, পরবর্তী সময়ে কস্টিউম ডিজাইনার হয়ে ওঠা ওয়েন্ডির সঙ্গেই ১৯৬৬ সালে ঘর বাঁধেন পিটার; এবং তার অনেকগুলো সিনেমায় প্রোডাকশন ডিজাইনারের দায়িত্ব দক্ষতা ও মমত্বের সঙ্গে সামলিয়েছেন ওয়েন্ডি।

সিডনিতে ফিরে, বিশ্ববিদ্যালয় সহপাঠিদের নিয়ে গড়ে তোলা ‘ইউবিইউ ফিল্মস’-এ নানা অড-জব করেন পিটার। বিনোদন জগতে তার প্রথম চাকরি– ১৯৬০ দশকের মধ্যভাগে; সিডনির টেলিভিশন স্টেশন ‘এটিএন-৭’-এ, দ্য ম্যাভিস ব্রামসটন শো শিরোনামের তুমুল জনপ্রিয় বিদ্রূপাত্মক অনুষ্ঠানের প্রোডাকশন অ্যাসিস্ট্যান্ট হিসেবে। পরে এই অনুষ্ঠানটির কয়েকটি ক্লিপ নিজেও ডিরেকশন দেন। নিজের কাজে এই টিভি স্টেশনের সুযোগ-সুবিধা কাজে লাগাতে তার বাধা ছিল না; ফলে, এ সময়ে দুটি শর্টফিল্ম বানিয়ে ফেলেন তিনি।

তৎকালীন কমনওয়েলথ ফিল্ম ইউনিট-এর [বর্তমান, ফিল্ম অস্ট্রেলিয়া] একজন ট্রেইনি ডিরেক্টর হিসেবে, নিজের প্রথম দিকের ফিচার-লেন্থ ডকুমেন্টারিগুলো নির্মাণ করেন। ১৯৭০ সালে মিচেল শর্টফিল্মটির জন্য, অস্ট্রেলিয়ান ফিল্ম ইনস্টিটিউট তাকে সে বছরের গ্র্যান্ড প্রিক্স অ্যাওয়ার্ডে ভূষিত করে। পুরস্কারের টাকা অবলম্বন করে, আবারও ইউরোপে পাড়ি জমান তিনি। আর লন্ডনে সময় কাটাতে থাকেন নিজের প্রথম দিকের ন্যারেটিভ ফিচার ফিল্মগুলোর কথা ভাবতে ভাবতে, স্ক্রিপ্ট লিখতে লিখতে। এক বছর পর আবারও অস্ট্রেলিয়ায় ফিরে এসে, কমনওয়েলথ ফিল্ম ইউনিট-এর হয়ে, ডকুমেন্টারি নির্মাণ শুরু করেন। এর মধ্যে হোয়াটেভার হেপেনড টু গ্রিন ভ্যালি? শিরোনামের সেই বিখ্যাত ডকুমেন্টারিটিও ছিল– যেখানে তিনি একটি ব্যর্থ সামাজিক এক্সপেরিমেন্টের শিকার অধিবাসীদের ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা ধারণ করেছিলেন।

নিজের প্রথমদিকে ননফিকশনাল ফিল্মগুলোতে, পিটার সিনেমার স্টাইল ও থিম নিয়ে যে এক্সপেরিমেন্টগুলোর বিকাশ ঘটিয়েছিলেন, পরবর্তী সময়ে সেই স্বাক্ষরগুলোই ফিল্মমেকার হিসেবে তাকে বিশ্ববিখ্যাত করে তোলে। প্রথম ফিচার ফিল্ম, হরর-কমেডি দ্য কারস দ্যাট অ্যাট প্যারিস-এর শুটিং তিনি শেষ করেন ২৭ দিনে। আর এ পর্যায়ে অস্ট্রেলিয়ান সাহিত্যিক জোয়ান লিন্ডসের উপন্যাস অবলম্বনে বানানো পিকনিক অ্যাট হ্যাংগিং রক হয়ে ওঠে তার জন্য সবচেয়ে জনপ্রিয় শৈল্পিক অর্জন। হ্যাংগিং রকে অ্যাপলইয়ার্ড কলেজ পড়ুয়া একদল ছাত্রীর একদিনের ট্রিপ ঘিরে এ সিনেমার গল্প। আচমকাই তিন ছাত্রী ও এক শিক্ষক অদৃশ্য হয়ে গেলে, আনন্দমুখর এই পিকনিক রূপ নেয় আতঙ্কে। অনেক সমালোচকের চোখেই এই ফিল্মটি চিহ্নিত হয়ে আছে ১৯৭০ দশকে অস্ট্রেলিয়ান ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিতে রেনেসাঁ ঘটানোর ল্যান্ডমার্ক হিসেবে। তার পরের সিনেমা, দ্য লাস্ট ওয়েভ পিটারকে আমেরিকান সিনে-বাজারে গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে নিতে ভূমিকা রাখে। খুনের মামলায় অভিযুক্ত চার অস্ট্রেলিয়ান আদিবাসীর পক্ষে মামলা লড়তে গিয়ে, পরাবাস্তব জগতের মুখোমুখি হয়ে পড়া এক শ্বেতাঙ্গ আইনজীবীর জীবনযাত্রা নিয়ে এর কাহিনী।

এ দুটি ফিল্মের সাফল্যের পর, গ্যালিপলি ও দ্য ইয়ারস অব লিভিং ডেঞ্জারাসলি [তখন তরুণ ও পরবর্তী সময়ে বিখ্যাত অস্ট্রেলিয়ান অভিনেতা মেল গিবসনকে কাস্ট করে এটি তার দ্বিতীয় সিনেমা]। এই শেষোক্ত সিনেমাটি যে বছর নির্মাণ করেছেন, সেই ১৯৮২ সালেই, অস্ট্রেলিয়ান ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিতে অবদান রাখার স্বীকৃতিস্বরূপ কুইন’স বার্থডে অনার লিস্টে জায়গা করে নিয়ে, এ.এম. [মেম্বার অব দ্য অর্ডার অব অস্ট্রেলিয়া] পদকে ভূষিত হন পিটার। অবশ্য, ১৯৮০ দশকের মধ্যভাগে, হলিউডের ডাকে সাড়া দিয়ে অস্ট্রেলিয়া ছাড়েন তিনি। এরপর টানা ২৫ বছর যুক্তরাষ্ট্রেই থেকে যান; এবং নিজের বানানো হলিউডি সিনেমাগুলোতেও নানা সংস্কৃতি, ফিস-আউট-অব-ওয়াটার ন্যারেটিভ, আধ্যাত্মবাদ, মৃত্যু ও মর্মযাতনা এবং আত্মার সন্ধান– নিজের অস্ট্রেলিয়ান সিনেমায় বিকাশ ঘটানো এই থিমগুলোর প্রতিফলন ঘটাতে থাকেন। হলিউডে বানানো নিজের প্রথম সিনেমা, ক্রাইম থ্রিলার উইটনেস দিয়েই সাড়া ফেলে দেন অস্কারে; অবশ্য আটটি ক্যাটাগরিতে নমিনেশন পেলেও ফিল্মটি জেতে দুটি অস্কার– বেস্ট অরিজিনাল স্ক্রিনপ্লে ও বেস্ট ফিল্ম এডিটিং।

এই সাফল্যের রেশ পরবর্তী সিনেমা, ড্রামা ফিল্ম দ্য মসকুইটো কোস্ট-এ পড়ে। ফিল্মটি আমেরিকান দর্শকদের মন্ত্রমুগ্ধ করে ফেলে। আর এর পরের সিনেমা, ডেড পোয়েট সোসাইটি পিটারকে এনে দেয় তার ফিল্মমেকিং ক্যারিয়ারের সবচেয়ে বড় বাণিজ্যিক সাফল্য এবং সমালোচনামূলক স্থূতি। বেস্ট অরিজিনাল স্ক্রিনপ্লে ক্যাটাগরিতে অস্কার জেতা এই ফিল্মটি হয়ে ওঠে একটি সমকালীন ক্লাসিক ফিল্ম। ১৯৯০ দশকজুড়ে তুরুপের বাণিজ্যিক তাস বেশ দক্ষতার সঙ্গেই ছড়াতে থাকেন পিটার; কিন্তু এ সময়ে, বাণিজ্যের চাপে, তার সিনেমার শিল্পমান ধীরে ধীরে ম্লান হয়ে ওঠতে থাকে। যদিও ‘হলিউডের চাকচিক্যে নিজেকে হারিয়ে ক্লান্তবোধ করছেন কিনা’– এমনতর সমালোচনার জবাবে সিনেমার এই সিনিয়র সিটিজেন বলেন, ‘না।… একজন মানুষকে একটা সময় ক্লান্ত হতেই হয়; কিন্তু সেটির সঙ্গে হলিউডের কোনো সম্পর্ক নেই।’ অবশ্য, হলিউড ছেড়ে, আবারও জন্মশহর সিডনিতে ফিরে এসেছেন তিনি। এখন থাকছেন সেখানেই। অনেকগুলো ফিল্ম প্রজেক্টই অসম্পন্ন রয়ে গেলেও, যতদূর জানা যায়, সিনেমা-নির্মাণ থেকে নিজেকে একরকম গুটিয়েই নিয়েছেন মাস্টার ফিল্মমেকার পিটার উইয়ার।

The last wave_FF
দ্য লাস্ট ওয়েব

পিটার উইয়ারের ফিল্মোগ্রাফি

শর্টফিল্ম

১৯৬৭– কাউন্ট ভিম’স লাস্ট এক্সারসাইজ । ১৯৬৮– দ্য লাইফ অ্যান্ড ফ্লাইট অব দ্য রিভারেন্ড বাকশট । ১৯৬৯– মিচেল । ১৯৭০– স্টায়ারিং দ্য পুল । টেম্পো । ১৯৭১– থ্রি ডিরেকশন ইন পপ মিউজিক । ১৯৭২– ইনক্রেডিওবল ফ্লোরিডাস । ১৯৭৩– হোয়াটেভার হেপেনড টু গ্রিন ভ্যালি? । 

ফিচার ফিল্ম

১৯৬৯– ম্যান অন অ্যা গ্রিন বাইক [টেলিমুভি] । ১৯৭১– হোমসডেল । ১৯৭৪– দ্য কারস দ্যাট অ্যাট প্যারিস । ১৯৭৫– পিকনিক অ্যাট হ্যাংগিং রক । ১৯৭৭– দ্য লাস্ট ওয়েভ । ১৯৭৯– প্লামবার [টেলিমুভি] । ১৯৮১– গ্যালিপলি । ১৯৮২– দ্য ইয়ার অব লিভিং ডেঞ্জারাসলি । ১৯৮৫– উইটনেস । ১৯৮৬– দ্য মসকুইটো কোস্ট । ১৯৮৯– ডেড পোয়েটস সোসাইটি । ১৯৯০– গ্রিন কার্ড । ১৯৯৩– ফিয়ারলেস । ১৯৯৮– দ্য ট্রুম্যান শো । ২০০৩– মাস্টার অ্যান্ড কমান্ডার– দ্য ফার সাইড অব দ্য ওয়ার্ল্ড । ২০১০– দ্য ওয়ে ব্যাক


সূত্র : গ্রেডসেভার । উইকিপিডিয়া । অন্যান্য

Print Friendly, PDF & Email
সম্পাদক: ফিল্মফ্রি । ঢাকা, বাংলাদেশ।। সিনেমার বই [সম্পাদনা/অনুবাদ]: ফিল্মমেকারের ভাষা [৪ খণ্ড: ইরান, লাতিন, আফ্রিকা, কোরিয়া]; ফ্রাঁসোয়া ত্রুফো: প্রেম ও দেহগ্রস্ত ফিল্মমেকার; তারকোভস্কির ডায়েরি; স্মৃতির তারকোভস্কি; হিচকক-ত্রুফো কথোপকথন; কুরোসাওয়ার আত্মজীবনী; আন্তোনিওনির সিনে-জগত; কিয়ারোস্তামির সিনে-রাস্তা; সিনেঅলা [৪ খণ্ড]; বার্গম্যান/বারিমন; ডেভিড লিঞ্চের নোটবুক; ফেদেরিকো ফেল্লিনি; সাক্ষাৎ ফিল্মমেকার ফেদেরিকো ফেল্লিনি; সাক্ষাৎ ফিল্মমেকার ক্রিস্তফ কিয়েস্লোফস্কি; সাক্ষাৎ ফিল্মমেকার চান্তাল আকেরমান; সাক্ষাৎ ফিল্মমেকার বেলা তার; সাক্ষাৎ ফিল্মমেকার নুরি বিলগে জিলান; ক্রিস্তফ কিয়েস্লোফস্কি; বেলা তার; সের্গেই পারাজানোভ; ভেরা খিতিলোভা; সিনেমা সন্তরণ ।। কবিতার বই: ওপেন এয়ার কনসার্টের কবিতা; র‍্যাম্পমডেলের বাথটাবে অন্ধ কচ্ছপ; হাড়ের গ্যারেজ; মেনিকিনের লাল ইতিহাস ।। মিউজিকের বই [অনুবাদ]: আমার জন লেনন [মূল : সিনথিয়া লেনন]; আমার বব মার্লি [মূল: রিটা মার্লি] ।। সম্পাদিত অনলাইন রক মিউজিক জার্নাল: লালগান

মন্তব্য লিখুন

Please enter your comment!
Please enter your name here