পথিকৃৎ চিত্রগ্রাহক কিউ. এম. জামান

578

লিখেছেন মীর শামছুল আলম বাবু

বাংলাদেশের চলচ্চিত্র জগতের প্রথম যুগের চলচ্চিত্রের কারিগরী নির্মাণের সাথে যে সব চলচ্চিত্র ব্যক্তিত্বের নাম ওতপ্রতভাবে জড়িত, কিউ. এম. জামান তাদের মধ্যে পথিকৃৎ। পাকিস্তান রাস্ট্রের জন্মের পর ভাষা আন্দোলনের প্রভাবে উর্দু ভাষার বিরোধীতা করে যে কয়েকটি ক্ষেত্রে বাঙ্গালীরা তাদের স্বতন্ত্র জাতীয়তাবাদ জাগ্রত করতে পেরেছিলো, ‘চলচ্চিত্র’ তাদের মধ্যে অন্যতম। ‘চলচ্চিত্র’কে হাতিয়ার করে উর্দু ভাষার দাপটের বিরোধীতা করে চ্যালেঞ্জে বিজয়ী আব্দুল জব্বার খান [১৯১৬-১৯৯৩]-এর ‘মুখ ও মুখোশ’ [০৩/০৮/১৯৫৬]-এর ক্যামেরা সৈনিক কিউ. এম. জামান [প্রকৃত নাম কাজী মেজবাহুজ্জামান, ১৯৩৩-১৯৯৯]। এদেশের প্রথম সবাক বাংলা চলচ্চিত্র বিনির্মাণের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কারিগরি অংশের কান্ডারি তিনি– ‘মুখ ও মুখোশ’-এর চিত্রগ্রাহক। তিনিই এদেশের চিত্রগ্রহণের পথিকৃৎ।

বাংলাদেশের তথা পূর্ব পাকিস্তানের চলচ্চিত্র জগত শুরুর [১৯৫৬] সময় যার শিল্প কুশলতায় সমৃদ্ধ হয়েছে এদেশের চলচ্চিত্রের প্রাথমিক ঝঞ্জাবিক্ষুব্ধ সময়গুলো, সেই কিউ. এম. জামান চলচ্চিত্রের চিত্রগহণ বিষয়ে ছিলেন একজন আইকন। প্রথম যুগের পথিকৃৎ চিত্রগ্রাহক কিউ. এম. জামানের শিল্প সৃষ্টির হাতিয়ার ছিল ক্যামেরা। যার তুলি হলো আলো-ছাইয়া; আর ক্যানভাস হলো সেলুলয়েড।

কিউ. এম. জামানের কর্মজীবন ঘটনাবহুল এবং বর্ণময়। ১৯৩৩ সালে কুমিল্লার হাজীগঞ্জে তার জন্ম। ভারতের কলকাতা ও বোম্বে চলচ্চিত্র জগতের কিছু চলচ্চিত্রে ছদ্মনামে সহকারি হিসেবে কাজ করতেন কিউ. এম. জামান। ভাষা আন্দোলনের ঠিক পরপরই ১৯৫৩ সালে পূর্ববঙ্গ পরিসংখ্যান বিভাগের এক সভায় ‘এদেশে চলচ্চিত্র নির্মাণ সম্ভব নয়’– এক উর্দু প্রেমীর দাম্ভিক ঘোষণার বিরোধীতাকারী নাট্যকর্মী আব্দুল জব্বার খানের চ্যালেঞ্জ স্বরূপ, কলকাতার চিত্রগ্রাহক মুরারী মোহন ঘোষের চিত্রগ্রহণে শুরু হয় ‘মুখ ও মুখোশ’-এর কাজ। জামান তখন সহকারী ছিলেন; কিন্তু মুরারী সব পারিশ্রমিক নিয়ে পুরো চলচ্চিত্র নির্মাণকে অনিশ্চতায় ফেলে চলে যাবার পর জব্বার সাহেবের আহ্বানে চিত্রগ্রহণের মতো কঠিন কাজটির হাল ধরেন কাজী মেজবাহুজ্জামান। ১৯৫৬ সালের ৩ আগস্ট ‘মুখ ও মুখোশ’-এর মুক্তির মধ্য দিয়ে সেই চ্যালেঞ্জে জয় হয় বাঙ্গালির; কিউ. এম. জামান হয়ে যান এদেশের পথিকৃৎ চিত্রগ্রাহক।

এরপর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের ঐতিহাসিক বিল পাশের মধ্য দিয়ে ১৯৫৭ সালে এফডিসি প্রতিষ্ঠার পর এদেশের চলচ্চিত্র শিল্পের গোড়াপত্তনের প্রাথমিক সময়ে সক্রিয় চলচ্চিত্র জীবনে তিনি চিত্রগ্রাহক হিসাবে অনেক চলচ্চিত্রে কাজ করেছেন। পথিকৃৎ পরিচালক আব্দুল জব্বার খানের দ্বিতীয় চলচ্চিত্র ‘জোয়ার এলো’ [১৯৬২] ছাড়াও ঢাকার চলচ্চিত্র শিল্পের প্রাথমিক যুগে চলচ্চিত্র– ফতেহ লোহানীর ‘আকাশ আর মাটি’ [১৯৫৯] ও ‘আসিয়া’ [১৯৬০], মহিউদ্দিনের ‘মাটির পাহাড়’ [১৯৫৯], এহতেশামের ‘এদেশ তোমার আমার’ [১৯৫৯], ‘রাজধানীর বুকে’ [১৯৬০], চান্দা [উর্দু; ১৯৬২], ‘নতুন সুর’ [১৯৬২] ও ‘সাগর’ [উর্দু; রঙ্গীন-১৯৬৫], মুস্তাফিজের ‘হারানো দিন’ [১৯৬১], ‘তালাশ’ [উর্দু; ১৯৬৩] ও ‘মালা’ [উর্দু, রঙিন, সিনেমাস্কোপ; ১৯৬৫], জহির রায়হানের ‘কখনো আসেনি’ [১৯৬১] ও ‘সোনার কাজল’ [কলিম শরাফি সহ যৌথ পরিচাললা; ১৯৬২], সুভাষ দত্তের ‘সুতরাং’ [১৯৬৪] ও ‘কাগজের নৌকা’ [১৯৬৬], ওবায়েদ-উল-হকের ‘দুই দিগন্ত’ [১৯৬৪], কামাল আহমেদের ‘উজালা’ [উর্দু; ১৯৬৬], কাজী জহিরের ‘ভাইয়া’ [উর্দু; ১৯৬৬], কারিগরের ‘সকিনা’ [১৯৬৮], ‘মিশর কুমারী’ [১৯৭০] ও ‘এক জালিম এক হাসিনা’ [উর্দু; ১৯৭০], জহির চৌধুরীর ‘পরশমণি’ [১৯৬৮, সাধন রায় সহ যৌথ চিত্রগ্রহণ], কাজী রহমানের ‘সপ্তডিঙ্গা’ [১৯৬৮] এবং স্বপরিচালিত ‘ভানুমতি’ [১৯৬৯] ও ‘ছদ্মবেশি’ [১৯৭০] প্রভৃতি চলচ্চিত্রের শৈল্পিক চিত্রগ্রহণ কিউ. এম. জামানের শিল্প নিদর্শন।

সাদাকালো সেলুলয়েড ফিল্মে আলো-ছায়ার খেলায় এবং ক্যামেরার দৃষ্টিকোণ ও লেন্সের ব্যবহার কিউ. এম. জামানের কর্মকুশলতার প্রস্ফুটন। এদেশের প্রথম ব্যবসা সফল চলচ্চিত্র ‘হারানো দিন’ [১৯৬১], প্রথম সুপারহিট চলচ্চিত্র ‘চান্দা’ [১৯৬২], প্রথম স্যুরিয়ালিস্টিক আলোকসম্পাত করা চলচ্চিত্র ‘কখনো আসেনি’ [১৯৬১], প্রথম বিদেশি পুরস্কারপ্রাপ্ত চলচ্চিত্র ‘সুতরাং’ [১৯৬৪] ও প্রথম রঙিন সিনেমাস্কোপ চলচ্চিত্র ‘মালা’ [১৯৬৫] তাঁর চিত্রগ্রহণ সৃষ্টিশীলতার তুঙ্গীয় নিদর্শন। সব মিলিয়ে ২৮/২৯ টি চলচ্চিত্র কিউ. এম. জামানের সফল চিত্রগ্রাহক জীবনের পরিচায়ক।

তাঁর সাথে কাজ করা সহকারীদের মধ্যে অনেকে পরবর্তীকালে চিত্রগ্রাহক হিসাবে বিখ্যাত হয়ে চলচ্চিত্র জগতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন। সক্রিয় চিত্রগ্রাহক জীবন ছাড়াও এদেশের একমাত্র সরকারী চলচ্চিত্র নির্মাণ প্রতিষ্ঠানের প্রথম ‘প্রধান চিত্রগ্রাহক’ হিসেবে বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের ঊষালগ্নে তিনি রেখেছেন গুরুত্বপূর্ণ অবদান। এই পথিকৃৎ চিত্রগ্রাহকের প্রয়াণ ঘটে ১৯৯৯ সালের ১৪ জুন।

Print Friendly, PDF & Email

2 মন্তব্যগুলো

Leave a Reply to syed mahfuz ali

Please enter your comment!
Please enter your name here